মঙ্গলবার, ১৭ জুলাই, ২০১২


অপুর দর্শন



অপারিজিত ১৯৫৭ তে সত্যজিৎ রায় এর ছবি। আমার অনুভুতিতে ভারতের চিরকালের আধুনিক ছবির শেষ কথা । 
বিভূতি ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর পথের পাঁচালি থেকে পরিচালক কিছু অংশ নিয়ে নিজের মত করে ভারতীয় সমাজ কে তুলে ধরেন পৃথিবীর সামনে। পথের পাঁচালি , অপারাজিত , অপুর সংসার । অপু নামের এক জীবনের চলার কাহিনী ক্রমশ বদলে গেল জীবন দর্শনে।
  

ছবির পটভূমি অনুযায়ী বাংলা ১৩২৭ সন প্রায় ৯০ বছর আগের এক গ্রামীণ বাঙালি ব্রাহ্মণ পরিবারের বালক এর আধুনিক জীবন খোঁজের সফর । এ আধুনিকতা কেবল শরীর বা পারিপার্শ্বিকতার নয়, এতো অন্য চলা যেখানে সব কিছু ছাড়িয়ে উঠে আসে মানুষ । তাই কাশী থেকে ফিরে আসতে হয় পিতাহীন অপুকে অন্তত পূজা করে সংসার চালাতে পারবে এই আশায়। বাংলার মাটিতে সর্ব প্রথম সে দেখতে পারে সেই রেলগাড়ি , আধুনিক পৃথিবীর গতিময় জীবনের নিদর্শন। সকালে পূজা চলতে থাকে কিন্তু সে মাকে জানায় “ মা আমি স্কুলে পড়ব ?” শুরু হয় বিজ্ঞান ভিত্তিক চলা, ক্রমশ পরিচিত হতে থাকি আমরা বাইরের বিশ্বের সাথে ।



এই আধুনিকতা বাস্তবিক হয়ে ওঠে ছাত্র অপুর মেধা আর জ্ঞান এ। এস্কিমো , থেকে আফ্রিকা , গ্যালিলিও থেকে পাস্কেল এ জানা তো বস্তুত বিশ্বের খবর জানা । অজ পাড়াগাঁয়ের বালক অপু যখন হ্যারিকেনের আলোতে সূর্য গ্রহণ কি? এর উত্তর পরীক্ষার মাধ্যমে বর্ণনা করে তখন ভারতীয় সমাজের কুসংস্কারের শাপমুক্তি ঘটে এ ছবিতে। স্কুল ফাইনাল এর পর কলকাতা যাওয়ার প্রস্তাব মুখমুখি দাড় করায় সম্পর্ক আর উন্নত জীবন কে। গ্লোবে কলকাতা খোঁজা তো নাম এর বাইরে ভূগোল কে খুজে দূরত্ব মেপে নেওয়া । মা কে ছেড়ে সেই রেলগাড়ি তে কলকাতা তো আবেগ এর মধ্যে থেকেও বার বার বধ্য জীবনকে প্রশ্ন করে আর কত রাস্তা গেলে মানুষ নিজের কাজ বুঝতে পারবে । প্রথম চিঠি তে তার ঘরে যে বৈদ্যুতিক বাতি আছে মাকে জানায়।




এই আধুনিক চিন্তা, মনন , দৃষ্টি এর আগে আর কোনও ভারতীয় ছবি তে দেখা জায়নি । জন রেনয়া বলে গেছিলেন “ তোমাদের ছবির নিজস্ব ভাষা যদি খুজে না নিতে পার তবে সেই ছবি কোনদিন চিরকালীন হবে না ” এর আগে ছিন্নমূল বা তারও আগে বিদ্যাপতী তে আভাস পাওয়া গেলেও পথের পাঁচালি থেকে অপারাজিত তে প্রতিষ্ঠা পায়।



আধুনিকতা মানে নিজস্বতাকে বিসর্জন নয় ,


“কোন ভাষা মরমে পুষি আকূল কোরে তোলে প্রাণ,
কোথায় গেলে শুনতে পাবো বাঊল সুরে মধুর গান ” 

ছাত্র অপুর পাঠে খুশি হেড স্যার, সেই কারনেই ছবিতে অপু শহর থেকে ফিরে পুকুরে স্নান করে , সূর্য ঘড়ি নষ্ট হয়ে যাওয়াতে পঞ্জিকা তে সূর্যউদয় এর সময় দেখে, ইচ্ছা করে ট্রেন ছেড়ে মা‘র কাছে ফিরে আসে।


তবে কোনও কিছু কে অর্জন করতে গেলে নিজস্বতা কে কিছুটা হলেও বিসর্জন দিতে হয় , ছবি তে অপুর সাথে ক্রমশ মা এর সম্পর্ক শীতল হয় , মানসিক দূরত্বের হিসাব “ ও কিছু টাকা মানিঅর্ডারে পাঠিয়ে দিয়েছি” মেলে না। পরিচালক পারতেন খুব সহজ ভাবে মা ও ছেলের মিল করিয়ে দিতে কিন্তু সেখানে আর এই বাস্তব টা থাকত না। এটাই শিক্ষা , দর্শন যা এ ছবি কে চিরকালীন করেছে। শেষ দৃশ্যে ভারতীয় সংস্কৃতির বেতের পাত্র যা অপুর মা ব্যাবহার করতেন এবং অপুর আধুনিক পৃথিবীর গ্লোব কে একই সাথে বেধে মা , বাবা হীন কিশোর এর কলকাতা যাত্রা তো আধুনিকতা আর নিজস্ব সংস্কৃতিরএকসাথে পথ চলার শুরু। এবং এ সফরে কোথাও বধ্যতা নেই , কূসংস্কর নেই ।


আবহ সঙ্গীত , ক্যামেরা , লাইট বা অভিনয় নিয়ে বলার ধৃষ্টটা আমার নেই। এ যে জীবনদর্শন।

বৃহস্পতিবার, ১২ জুলাই, ২০১২

গ্যাংস অফ ওয়াসেপুর--সত্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সত্যের উন্মোচন।।







আমরা যারা সহজে মেনে নিই সত্যকে আমরা । যারা সত্যকে বিচার করি না, তাকে যাচাই করি না, শুধুমাত্র মেনে নিতেই শিখেছি, তাঁদের কাছে উৎসাহ উদ্দিপনা সবই হারিয়ে যায় আসল সত্যের আড়ালে, যখন সত্য বলতে কোন একটা বিষয় কে বোঝায় না অনেক গুলি বিষয়ের মেলবন্ধনকে বোঝায় ।  সত্য কখনও একটা হতে পারে না, সবসময়ই তা একের অধিক হ্য়আর সেখানেই গ্যাংস অফ ওয়াসেপুর এর নিজস্বতা কোন একটা সত্যের উন্মোচন করতে গিয়ে একের অধিক সত্য আমাদের সামনে উন্মোচিত হয় পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপ বরাবরই একটু ভিন্ন স্বাদের ছবিই পরিচালনা করেন আর তাই তাতে বলিউডের ট্রেডমার্ক থাকে না তাই এই ছবিটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে ডিরেক্টরস' ফোর্টনাইট বিভাগে প্রদর্শিত হওয়ার পর এক সমলোচককে বলতে হয় এই ছবি ভারতীয় সিনেমাতে এক নতুন দিশার উন্মোচন করল


আমাদের ছবির জগতে গ্যাংস অফ ওয়াসেপুর নিছক একটা ছবি হয়ে থাকবে শুধুমাত্র তার গল্পের জন্য নয়, গল্পের ব্যবহারিক করন, গল্পে চরিত্রের প্রয়োগ, গল্পের মাধ্যমে তথ্য প্রদান সবকিছু মিলে

তাই বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের ধানবাদ শহরের অনতিদূরে অবস্থিত ওয়াসেপুর যখন মানচিত্রে থেকেও আমাদের মনে থাকে না, সেই একটা জনপদের গল্প  গ্যাংস অফ ওয়াসেপুর যে স্বাধীনতার প্রাক্কাল থেকেই অনেক ইতিহাসের সাক্ষী 

পরিচালক এক বিরাট সময়ের কথা এখানে বলতে চেয়েছেন যেখানে সময়টা স্বাধীনতার আগে থেকেই শুরু হয়েছে ভারতবর্ষের অন্যতম খনিজ সম্পদ "কয়লা" এর খনির জন্য বিখ্যাত ধানবাদ ও তার আশেপাশের অঞ্চল খনির সাথে সাথে খুনিদের ও দেখে এসেছে

একটা জনপদ যেখানে দুটি গোষ্টি যাদের কাজ এর থেকে কুকাজই বেশী তারা মালবাহী রেলগাড়ি থামিয়ে লুট করেই প্রধানত লুটের সাম্রাজ্যে লুটতরাজ হয় এ হেন এক লুটতরাজ শাহিদ খান যে শত্রু পক্ষের হাত থেকে পালিয়ে প্রাণে বেঁচে সংসার নিয়ে বাসস্থান ত্যাগ করে সময় পাল্টায় কিন্তু নতুন দিন ও কালো মুখোশ পরে নেমে আসে  তাই মনোজ বাজপায়ি ওরফে সর্দার খানকে তাঁর বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার পালা শুরু করতে হয় অনেক ছোটো থেকেই কেশহীন হওয়ার সুচনার সময়কালে

একটা বিশাল সময়ের কথাকে বলতে গিয়ে, একটা প্রকাশ্য আলোয় না আসা সামাজিক বিষয়ের কথা বলতে গিয়ে পরিচালক এই ছবিতে প্রচুর চরিত্রের সৃষ্টি করেছেন যেখানে প্রতিটা চরিত্রের চলনের মাধ্যমে আমরা একটা ইতিহাসের কথা জানতে পারি, একটা স্বাধীন দেশের সাম্রাজ্যবাদী লুটতরাজদের কথা জানতে পারি

ঐতিহাসিক গল্প সৃষ্টির মাধ্যমে গল্পের চরিত্ররাও তাই ঐতিহাসিক হয়ে উঠেছে একটা কয়লাখনির পার্শ্ববর্তী অঞ্চল, কয়লা মাফিয়াদের বেহায়াপানা, দখলদারির জন্য খুন, জেল থেকে পালানো- সবই এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম অবধি অতিবাহিত হয় তাই কোন এক আঙ্গিকে গ্যাংস অফ ওয়াসেপুর এক কাব্য হয়ে ওঠে, মহাকাব্যিক আখ্যানে হয়ত না দেওয়া গেলেও কোন অর্থে   গ্যাংস অফ ওয়াসেপুর শুধু মাত্র একটা গল্প হয়ে থাকবে না

মহাকাব্য হয়ত হয়ে উঠলেও উঠতে পারত যদি তা সর্বাগ্র ভাবে কোন পক্ষকে বিরোধী পক্ষ ঘোষণা করত, তাহলে হয়ত আমরা ও আমাদের দূরদৃষ্টিতে খুজে পেতাম মহাকাব্যের নায়ককে জার দুঃখে হয়ত আমরাও কেঁদে উঠতাম, যার রাগে হয়ত আমরাও তাঁর বাবার খুনের বদলা নিতে তাকে সাহায্য করতাম তাই এখানেই এই ছবি আর পাঁচটা ছবির থেকে আলাদা, মহাকাব্যের দর্শনের নীতিমূলক কাঠামোর বাইরে

তাই মনোজ বাজপায়ির বাবার মৃত্যুতে তাঁর মত আমার কান্না পায় না, তাঁর হাতে আমিও চাই না বন্দুক উপহার দিতে, কিন্তু সেও যে বদলার আগুনে ফুটছে, তা আমার কাছে পরিস্ফুট হয় না তাই তাঁর বদলার আগুন আমার হৃদয় কে স্পর্শ করে না

আলাদাভাবে অনুরাগ বাবুর সিনেমাটোগ্রাফি নিয়ে বলার কিছু নেই, বারে বারেই আমরা দেখে এসেছি তাঁর ছবির সিনেমাটোগ্রাফি আর পাঁচটা বলিউডের ছবির থেকে আলাদা ডার্ক ইমেজ ব্যাবহার করার তীব্র প্রবণতাই তাঁর ছবিকে আর পাঁচটা হিন্দি ছবির থেকে আলাদা করে তুলেছে

ছবির সঙ্গীত ও আবহসঙ্গীত নিয়ে আলাদা করে বলতেই হবে কারন ছবির মধ্যে মহাকাব্যিক উপকরন হিসাবে সঙ্গীত একটা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে লোকগীতির কথা লোকায়ত সঙ্গীতের পূর্ণ ব্যবহার ছবিটাকে তার পরিচালিত বৃত্তের বাইরে বেরতে দেয় নি তাই এটা শুধু ওয়াসেপুরের কাহিনী হিসাবেই রয়ে গেছে আর তাই কোন একটা জনপদের কাহিনী দেখতে দেখতে আমি ও আমার পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাথেও মিল খুজে পাই
আমি অনুভব করতে পারি আমার পরিচিত নরেন দার কথা, যার ছোট একটা টেলরের দোকান ধূলিসাৎ করে দিয়েছিল সামাজিক মাফিয়ারা, শুধুমাত্র তাঁদের না জানিয়ে দোকান ঘরটি কেনার জন্যে

মাফিয়াবৃত্তি আমাদের দেশের কলকব্জাকে চিরদিনই গুঁড়িয়ে দেওয়ার কথাই ভাবে, তাই হয়ত ১৯৪১ ের কয়লা মাফিয়ার ওয়াসেপুর এখন চরম অন্ধকারেই তলিয়ে আছে, তা না হলে বেনারসে ছবির শুটিং এঁর সময় ছবির সহপরিচালক সোহেল সাহ এর আকস্মিক মৃত্যুও কোথাও গিয়ে খুনের ইঙ্গিত বহন করে

তাই ওয়াসেপুরের বাসিন্দাদের অভিযোগ কোথাও গ্রাহ্য হয় না, ছবিতে সেন্সরের কাঁচি চলে না আধির আগ্রহে তাই অপেক্ষা করছি ছবির দ্বিতীয় অংশটির জন্য সেখানেই হয়ত কাব্য নিছক কাব্য না হয়ে মহাকাব্যিক আখ্যান হয়ে উঠবে।।