শুক্রবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১২

ভালবাসা আর "বরফি"- বরফ গলে পুরো জল





আমরা যারা মানুষ যারা মানুষের মত আচরন তারা সবাই হয়ত মনে মনে মানি বা জনে জনে বলি ভালবাসা দেশ কাল সীমানা মানে না ভালবাসা একটা অনুভুতি সেটা শুধু অনুভব করা যায়। ভালবাসার রূপ নেই গন্ধ নেই ভাষা নেই, ভালবাসা নিস্চুপ। অনুরাগ বাসুও হয়ত আমাদের আবার বললেন ভালবাসার কোন ভাষা হয় না। ছোটবেলায় জন্ম লগ্নে মা মারা যাবার পর বাবা মূক ও বধির ছেলের নাম রাখেন মরফি। কালক্রমে সেটাই হয়ে যায় বরফি। সেই সিনেমা আবিস্কারের আদি পর্বে যখন সিনেমার কোন শব্দ ছিল না কোন সংলাপ ছিল না আজকের দিনে এসেও মনে হয় পরিবেশ আর অভিনয় থাকলে সেখানে আজও বেশী সংলাপের প্রয়োজন হয় না। আমার বারবার মনে হয় সেই নেপোলিয়নের কথা -যুদ্ধের প্ল্যান যদি হয়ে গিয়ে থাকে তাহলেই যুদ্ধ প্রায় হয়ে গিয়ে থাকে তেমনি সিনেমারও যদি চিত্রনাট্য লেখা হয়ে যায় তাহলে সিনেমাও প্রায়ই হয়ে গিয়ে থাকে। সবাই তো আর ঋত্বিক কুমার ঘটক না যে চিত্রনাট্য মাথায় নিয়ে ঘুরবে। জমাটি চিত্রনাট্যই একটা ভাল ছবির উপহার দেয়। যেমন অনুরাগ বাসু পরিচালিত রনবির কাপুর, প্রিয়াঙ্কা চোপরা, এলিনা ডিক্রুজ অভিনীত “বরফি”। এক বাক্যে যদি সিনেমার গল্প বলতে হয় তাহলে এটাও আর পাঁচটা বলিউডের সিনেমার মত ত্রিকোণ প্রেমের কাহিনী। কিন্তু একটা গল্পকে প্রদর্শন করার আঙ্গিক তার ভঙ্গিমা বদলে দেয়। একটা অদ্ভুত ন্যারেটিভে বেঁধেছে গল্পটাকে লেখক অনুরাগ বাসু। তিনটে সময়কে তুলে ধরা হয়েছে ১৯৭২,১৯৭৮ ও আজকের দিন। কিন্তু কোথাও ছবিটা একটা লিনিয়ারিটিকে ধরে এগিয়ে যায় নি। একটা সময়ের মধ্যে আর একটা সময় ঢুকে পড়েছে। আবার কোথাও দুটো সময়কে সমান্তরাল ভাবে দেখানো হয়েছে। খুব কঠিন একটা ন্যারেটিভ এর ধরন বহুদিন বাদে বাণিজ্যিক হিন্দি ছবিতে নজর এল।
হাসির মোড়কে একটা প্রেমের গল্প দেখা গেল। যেখানে দেখতে দেখতে বারবার একজনের কথাই মনে পরছিল তিনি মহর্ষি চ্যাপলিন। কিভাবে নিজের শরীরকে ব্যাবহার করে বিন্দুমাত্র সংলাপ ছাড়া অভিনয়কে তুলে ধরা যায় রনবির আবার সেটা করে দেখালেন। দার্জিলিঙয়ের পটভূমিতে ছবির গল্প এর প্রধান উৎস হলেও মাঝে মাঝে সে পাহাড় ছেড়ে সমতলে নেমে এসেছে। কখন বা বাংলার সবুজ গ্রাম কখনও বা কলকাতা।
দার্জিলিঙে আসা সুন্দরী শ্রুতি এর প্রেমে পরে বরফি যখন হাবুডুবু তখন তাঁর প্রেমেও শ্রুতি মাঝ সমুদ্রে সাঁতরে যাচ্ছে। কিন্তু মানবিক দ্যোতনাকে কখন সে পরিত্যাগ করতে পারে নি তাই কখনই পারে নি একজন প্রতিবন্ধীকে আপন করে নিতে। ছবির শুরুতেও পারে নি শেষেও পারেনি। তাই একসময় এসে তাকে আক্ষেপ করতে হয় “আমারা যারা সম্পূর্ণ তারা তাদের ভালোবাসার পূর্ণতা পায় না কিন্তু বরফি নিজে সম্পূর্ণ না হয়েও সম্পূর্ণ ভালবাসা পায়।” এই সম্পূর্ণ ভালবাসাই আসলে ঝিলমিল রুপী একজন মানসিক রুগী প্রিয়াঙ্কা চোপরা। যাকে পরিবার চিরকালই তাদের থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল শুধুমাত্র তাঁর নামে হয়ে যাওয়া তাঁর দাদুর সম্পত্তির জন্য, এই ঝিলমিলকে নিয়েই বরফি পাড়ি দেয় কলকাতা। অনবদ্য এক প্রেমের কবিতা লিখেছেন এ পর্যায়ে অনুরাগ। দুই প্রতিবন্ধীর ভিতরকার আবেগ তাদের ভালবাসা যে আমাদের সাধারন সুস্থ মানুষের থেকে কতটা আলাদা তাই যেন এ কবিতায় লেখা।
এই ঝিলমিলকে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও বড় অদ্ভুত, এর আগে তাই রনবিরকে কখনও কিডন্যাপার হতে হয় তো কখন ব্যাঙ্ক লুটেরা। ঝিলমিলের চরিত্রে প্রিয়াঙ্কা সত্যিই অনবদ্য এককথায়। আবারও “সাতখুন মাফ” এর পর তিনি বোঝালেন তিনি কেন বাকিদের থেকে আলাদা। পুলিশ অফিসারের চরিত্রে সৌরভ শুক্লা, যার ভাষায় আমরা গল্পের অনেকটা শুনি, তিনিও অসাধারন।
ছবির শুরুতে একটা প্রেম আর শেষের দিকে একটা প্রেম, দুইয়ের পটভূমিকাটা আলাদা দুইয়ের পরিবেশটা আলাদা। এই দুই প্রেমের ক্ষেত্রে কোথাও যেন পরিবেশ একটা তৃতীয় চরিত্র হতে পারত কিন্তু এই তৃতীয় চরিত্রটির বড় অভাব যে চোখে পড়েছে তা অনুরাগ বাবু নিজেই বলেছিলেন “বেশ কিছুদিন আরও ইচ্ছা ছিল এখানে (দার্জিলিং) শুটিং করবার কিন্তু হল না”। তাই এই দায়ভার থেকে নিজেকেও দূরে সরিয়ে রাখা যায় না, আমার শহর আমার রাজ্য আজ আর আমার নয় এখানে আমি কোন কাজ করতে গেলে সকলের অনুমতির প্রয়োজন হয়।
তাই যে দার্জিলিং কে আমরা চিরকাল তাঁর সুরভিত গন্ধের তাগিদে তার রুপময় রূপ দেখে এসেছি। বরফি এসে কোথাও সামান্য পরিমানে এই রূপের অন্তরে ঢুকে পরে, আর তাই আমরা মাথাভাঙ্গার কোন এক নেপালি গ্রাম কে দেখতে পাই, ছৌ নাচ দেখতে পাই। হয়ত প্রথমবার এমন একটা বাণিজ্যিক হিন্দি ভাষার ছবিতে ছৌ নাচ
এর অংশগ্রহণ আমাদের মনে বাড়তি উৎসাহ সৃষ্টি করে যার জন্য অবশ্যই অনুরাগ বাবুর একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য। আর একজন এর কথা এখানে বলতেই হয় তিনি সঙ্গীত পরিচালক প্রীতম। প্রতিটা মুহূর্তকে সঙ্গীত যেন আলিঙ্গন করে রয়েছে। যেমন আবার সেই “লাইফ ইন আ মেট্রো” এর মত তিনজন মানুষ বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে যায় আর পুরো গল্পটাকে একটা মিউজিক্যাল মুড দেওয়ার চেষ্টা করে। সত্যিই সঙ্গীত ও আবহ সঙ্গীত এদিক সেদিক পরে থাকা টুকরো টুকরো মুহূর্তকে একনিষ্ঠ করে পুরো গল্পটাকে পরিবেশন করেছে।
শেষত বলতেই হবে পশ্চিমবাংলার উত্তাল সময়ের একটা মিষ্টি প্রেমের গল্প বলতে গিয়ে ছবি কখনই এই গল্পের বাইরে বেরিয়ে পরে চারিপাশের পরিবেশের সাথে জড়িয়ে পড়েনি। শুধুমাত্র জ্যোতি বসুর দেওয়াল চিত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। প্রতিটা মুহূর্ত খুব যত্ন সহকারে বোনা হয়েছে তাই বরফি অসংখ্য মুহূর্তের মেলবন্ধনের গল্প। যেখানে আবার বলতে হয় মুহূর্ত কে অনুভব করার জন্য তাকে বোঝার জন্য ভাষার প্রয়োজন হয় না, যেমন আমরা সাংকেতিক ভাষা না জেনেও বরফির ভাষাটা বুঝতে পারি।
আমার বারবার ছবিটি দেখতে দেখতে একটা কথাই মনে হচ্ছিল মাখন জ্যেঠুর ছেলে সুবোধদার কথা। সুবোধদাও কথা বলতে ও কিছু শুনতে পায় না। মাখন জ্যেঠুর অবস্থা খুব একটা ভাল নয় তাই ছেলেকে শোনার মেশিন কিনে দিতে পারে নি। মারা যাবার কিছুদিন আগে ছেলের বিবাহ দিয়ে গিয়েছিল। পুত্রবধূও মূক ও বধির। কিছুদিন আগে আমাদের বাড়িতে এসেছিল ১০ মাসের ঋষভ সাথে নিয়ে। খুব মিষ্টি দেখতে হয়েছে ওদের ছেলেটাকে। তাই বারবার মনে হচ্ছিল একমাত্র ভালবাসাই পারে অসংখ্য অসম্পূর্ণতার মাঝেও নিজেদের একে ওপরের প্রতি ভালবাসা খুঁজে নিতে।
ছবিঃ বরফি
অভিনয়ঃ রনবির কাপুর, প্রীয়াঙ্কা চোপরা, ইলিনা ডীক্রুজ, সৌরভ শুক্লা, আশিস বিদ্যার্থী, জিশু সেনগুপ্ত, হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।
সঙ্গীতঃ প্রীতম
চিত্রনাট্য, সংলাপ ও পরিচালনাঃ অনুরাগ বসু