১৯৫৫ সালে নির্মিত একটি ছবি। একটি
পরিবারের কাহিনী। সারাবিশ্বে বাংলা তথা ভারতীয় ছবির সংজ্ঞা বদলে দেওয়া সেই ছবিটি ‘পথের
পাঁচালি’। এই ছবিরই পরের দুটো অংশে ছবির পরবর্তী কাহিনীই বহমান। প্রথম অংশে বালক
অপু থেকে দ্বিতীয় অংশে যুবক অপূর্ব হয়ে ট্রিলজির শেষ অংশে মধ্যবয়স্ক অপূর্বর
অন্তহীন যাত্রার মাধ্যমে ছবির সমাপ্তি। এই ছিল অপুর কাহিনী। বিভূতিভূষণের অপূর্ব
এই ভাবেই সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে স্থান পেয়েছিল। আমরা সকলে এক জীবনযাত্রার সাক্ষী
হয়েছিলাম। আমরা অপূর্বর সেই মেঠো পথে এগিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে ফেলে রেখে এসেছিলাম তার
বাকি জীবন কাহিনীকে। প্রয়োজন হয়নি কখনও পরের কাহিনী ফিরে দেখার। আমরা মেনে
নিয়েছিলাম বলা বাহুল্য ভেবে নিয়েছিলাম অপুর জীবনের শান্তিময় পরিসমাপ্তি। কিন্তু
সুবীর ব্যানার্জি কে কি আমাদের মনে আছে? নাহ আমার তো ছিল না।
‘পথের পাচালি’তে অপুর চরিত্রে
অভিনয় করা শিশু চরিত্রের সামাজিক নাম সুবীর ব্যানার্জি। এরপর আর আমরা তাকে দেখিনা।
ভিড়ের মাঝে মিলিয়ে যান তিনি। সেই ভিড়ে কখনও প্রয়োজন হয়নি তাঁকে খুঁজে বের করবার।
২০১৪ তে এসে হঠাৎ তাঁকে খুঁজে পাওয়া গেল ‘অপুর পাঁচালি’তে। ছবির জগতে বিশ্ববন্দিত
শিশু চরিত্রগুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান চরিত্র হল অপু। হ্যাঁ ‘পথের পাচালি’র অপু।
কিন্তু সুবীর ব্যানার্জির সাথে অপুর সম্পর্ক কোথায়? তিনি কি শুধুই অপুর চরিত্রে
অভিনয় করা অভিনেতা নাকি অপুর চরিত্রে অভিনয় করে সাফল্য লাভের পরবর্তী সময়ে হারিয়ে
যাওয়ার মধ্যেই আছে তার সাথে অপুর সম্পর্কের কোন অন্তর্ধান রহস্য।
ছবি নিয়ে পড়াশুনা চলাকালিন অপুর
সাথে বেশ কিছু সময় কেটেছে। তাঁকে খুব গভীর ভাবে চেনা গেছে। কিন্তু সুবীর বাবুর কথা
কোথাও আসেনি। আর এলেও সেটা খুব কম। হয়ত আমিই তাঁকে অগ্রাহ্য করে গেছি। কারন আমার
তো অপুকে জানার প্রয়োজন সুবীর বাবুকে তো নয়। কিন্তু এতদসত্তেও কিছু কিছু বইয়ের
পাতায় সুবীর বাবুর কথা উঠে এসেছে। অপুর জীবনকাহিনী আর সুবীর বাবুর জীবনকাহিনীর
মধ্যে এক আশ্চর্য মিল খুঁজে পাওয়া গেছে। একই সরলরেখায় বহমান দুটি জীবন। একজনের
অবস্থান পর্দার ওপারে আর একজনের বাস্তবের মাটিতে।
২০১৪ তে এসে আপামর বাঙালী জাতি
(বিশেষ করে এপার বাংলার) মহোৎসব করতেই পারে কারন প্রায় দীর্ঘ ৬০ বছর বাদে বাস্তবের
অপুকে খুঁজে পাওয়া গেছে। চায়ের টেবিলে তর্কের ঝড় তুলতেই পারে যে কতটা মিল আর কতটা
অমিল এদের দুজনের মধ্যে। প্রশ্ন উঠতেই পারে ঘোলাটে তামাটে পর্দার অপু অর্থাৎ সুবীর
বাবুও কি রূপোলী পর্দার অপুর মত কালপুরুষ দেখেছিল? এরকম কয়েক হাজার প্রশ্ন উঠতেই
পারে। আর এর সমস্ত কৃতিত্ব যাবে ‘অপুর পাচালি’র পরিচালকের অপর। শেষমেশ তিনি তো
পেরেছেন এই কাজ সম্পন্ন করতে। হাজির তো করতে পেরেছেন অপুকে এত দীর্ঘ অবসানের পর।
জীবনকাহিনী নিয়ে ছবি অনেক হয়েছে।
অধুনা ‘ভাগ মিলখা ভাগ’ বা ‘পান সিং তোমার’ এর মত ছবি আমরা দেখেছি। যেখানে ব্যাক্তি
উল্লেখযোগ্য স্থান পেয়েছে ছবিতে তার জীবনকাহিনীতে ঘটা কোন ঘটনা নয়। চড়াই উৎরাই
সকলকেই পেরিয়ে আসতে হয়েছে। কিন্তু শেষে এসে কোন আফসোস ছিলনা চরিত্রদের। ‘অপুর পাঁচালি’র ব্যর্থতা এখানেই।
বারবার অপু তথা সুবীর ব্যানার্জি আফসোস করতে থাকে তার হারিয়ে যাওয়া নিয়ে। ভুলে
যাওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা এটা তিনি মেনে নিতে পারেনা। তাই ছবির শুরু থেকে শেষ
অবধি যতবার তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয় তিনিই অপু কিনা ততবার তিনি আকস্মিক ক্রোধে
আক্রান্ত হয়ে ওঠেন। ভুলে যাওয়ার পিছনের ঘটনা ব্রাত্যই থাকে।
দর্শককে বারবার অপুর সাথে সুবীর
বাবুর সম্পর্কের যে মিল তা বুঝিয়ে বলার প্রবণতা ছবির শুরু থেকে শেষ অবধি করা হয়েছে
তা খুব ক্লিশে বলেই মনে হওয়া স্বাভাবিক। পরিচালক ধরেই নিয়েছেন যে ট্রিলজির সব কটা
ছবিই সবার দেখা। কিন্তু প্রেক্ষাগৃহে পাশের সিটে বসা যুবক যুবতীরা যখন অপু, ‘অপরাজিত’র
অপূর্ব, ‘অপুর সংসার’এর সৌমিত্র এবং ‘অপুর পাঁচালি’র সুবীর বাবুর চরিত্রে অভিনয়
করা পরমব্রত ও অর্ধেন্দু ব্যানার্জির মধ্যে খেই হারিয়ে ফেলে বারবার তালগোল পাকিয়ে
একাকার করে ফেলে তখন বোঝা যায় যারা নিজের ভোটদান কেন্দ্রের সকল প্রার্থী সম্পর্কেই
ওয়াকিবহাল নয় তাদের কাছ থেকে কিভাবে পরিচালক এটা আশা করেন যে তারা এই সকল চরিত্রকে
চিনে নিতে পারবেন।
তাই বোঝা দায় হয়ে যায় আসলে
পরিচালক ঠিক কি বলতে বসেছেন অপুর সাথে সুবীর বাবুর জীবনযাত্রার মিল নাকি একটি
হারিয়ে যাওয়া চরিত্রের গল্প। এত বারবার করে অপু আর সুবীর বাবুকে এক অপরের পরিপূরক
হিসেবে দেখানোর কি প্রয়োজন ছিল। অপুর সাথে সুবীর বাবুর পরিচয় করিয়ে দিয়ে তারপর কি
তার গল্প বলা যেত না? নাকি ছবির মুল ইউএসপিই এটা ছিল যে কতটা মিল খুঁজে পাওয়া যেতে
পারে। বারবার জোর করে একটা মিল বের করবার প্রবণতা লক্ষ্যনিয়। সেখানে কল্পনার আশ্রয়
নিতে হয়েছে তা বেশ বোঝা যায়। যদি কল্পনার আশ্রয়ই নিতে হয় তাহলে কাল্পনিক আর
প্রতীকী চরিত্রের মধ্যে কীভাবে বিভেদ রেখা টানা যায়।
‘পথের পাঁচালি’র সিগনেচার সুর
একটা মাইলস্টোন। ট্রিলজির তিনটি ছবিতেই সেই সুর ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজন
সাপেক্ষে। দৃশ্যের পরিকাঠামোর ওপর নির্ভর করেছে সুরের ব্যবহার। কিন্তু ‘অপুর
পাঁচালি’তে সেই সুর ও শুধুমাত্র এই ছবির জন্য সুরারোপিত সুর প্রায় সর্বক্ষণ
দৃশ্যের পশ্চাতে বেজে চলে। যদিও তা অপ্রয়োজনীয় বলেই মনে হওয়া স্বাভাবিক।
উল্লেখযোগ্য সুবীর বাবুর বিবাহের দৃশ্য চলাকালীন হঠাৎ করে ক্যামেরার পিছু হঠার
সাথে সাথে বাঁশির করুণা মিশ্রিত সুরের ব্যবহারের কি প্রয়োজনিতা তা বিচার সাপেক্ষ।
আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি সম্পন্ন মস্তিষ্ক এর কারন অনুসন্ধান করতে পারেনা। কারন যদি
বিবাহ পরবর্তী জীবনের ভয়ানক পরিস্থিতির কথা ভেবেই এই করুণা মিশ্রিত সুরের ব্যবহার
করা হয় তাহলে দর্শকে আগে থেকেই বলে দেওয়ার কোন প্রয়োজন ছিলনা সুবীর বাবু এ সংসারে
একা। ছবির শুরু থেকেই ওনাকে একা দেখানো হয়েছে। তাই ধরে নেওয়াই যেতে পারে ওনার একা
থাকার পিছনে নিশ্চই কোন কারন আছে অবশ্যই।
অভিনয় নিয়ে আলাদা করে বলার কোন
প্রয়োজন নেই। বাংলা ছবির দর্শক বেশ কিছু বছর ধরে বাংলা ছবি দেখে দেখে বুঝে নিতে
সক্ষম হয়েছে কোন চরিত্রে কে অভিনয় করতে পারে। দীর্ঘ সময় ধরে এর কোন পরিবর্তন হয়নি
আর হবে বলেও কোন আশা করা যায়না। তাই সকলেই যথাযথ অভিনয় করবে বলেই ধরনা কারন
চরিত্রেরা সকলেই তাদের পরিমিত গণ্ডির মধ্যেই ঘোরা ফেরা করে।
এসব সত্তেও পরিচালককে বাহবা দিতেই
হবে শুধুমাত্র একটি কারনেই যে ক্রমাগত ভুলতে থাকা বাঙালি জাতিকে আরও একবার ফেলে
আসা সময়ের চরিত্রদের কথা মনে করিয়ে দেওয়া যারা আমাদেরকে এক এক সময়ে বিশ্বের
মানুষের কাছে বাঙালি হিসেবে পরিচয় দিয়ে এসেছে।।
ছবিঃ অপুর পাঁচালি
অভিনয়েঃ পরমব্রত, অর্ধেন্দু
ব্যানার্জি, পার্নো মিত্র, গৌরব চক্রবর্তী, ঋত্বিক চক্রবর্তী প্রমুখ।
সঙ্গীতঃ ইন্দ্রদীপ দাসগুপ্ত
পরিচালনাঃ কৌশিক গাঙ্গুলি।