ঋত্বিক কুমার ঘটক,
একটা প্রতিস্টান, একটা বিষয়। গোটা জীবন দিয়েও হয়ত তাকে বোঝা অসম্ভব। যেমন অসম্ভব তাঁর গোটা একটা ছবি কে নিয়ে লেখা। তাই ও পথে আমি আর গেলাম না। আমি তাঁর ছবির ছোটো
একটা দৃশ্যের কথা
বলি। "মেঘে ঢাকা
তারা" ঋত্বিক বাবুর চতুর্থ ছবি। যে ছবিটা হয়ত প্রত্যক্ষ ভাবে বা পরোক্ষ ভাবে প্রত্যেক বাঙালীর কথাই বলে। ছবিতে রবি ঠাকুরের ব্যবহৃত গান "যে রাতে মোর দুয়ার গুলি
ভাঙল ঝড়ে" এর দৃশ্যায়নে যে গুঢ় অর্থ লুকিয়ে
আছে তার আলোচনাই এ লেখার অন্যতম উদ্দেশ্য।
ছবির মূল ভাবধারায় না গিয়ে যদি মাত্র শুধু দেবব্রত
বিশ্বাস ও গীতা ঘটকের কণ্ঠে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের সঙ্গীত পরিচালনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানটির দৃশ্যায়নে যাওয়া যায় তাহলে আমরা প্রথমত সমগ্র
গানটির দৃশ্যে দুটি চরিত্রকে দেখতে পাই। চরিত্রগুলির নামাকরনে যদি যাওয়া যায় তাহলে একজন ছবির প্রধান প্রতিনিধি
"নীতা" আরেকজন তাঁর দাদা "শঙ্কর"। অভিনয়ে সুপ্রিয়া দেবী ও অনিল ।
গানটির শুরুই হয়
নীতার সংলাপ দিয়ে " দাদা আমায় গান শেখাবি.........বাসর ঘরে গান গাইতে হবে যে।" সংলাপ শেষের সাথে সাথেই গান শুরু হয়।
প্রথম শট ক্লোস আপ শঙ্কর
ওরফে নীতার দাদার। ক্যামেরা স্থির
এক জায়গায়। গান শুরু হয়। "যে রাতে মোর দুয়ার গুলি ভাঙল ঝড়ে।" প্রথমে শঙ্কর মাথা নীচু করে চোখ বন্ধ করে গান শুরু করে। তারপর মুখ ফিরিয়ে নেয়। এখানেই এই দৃশ্যের শেষ হয়।
এই দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই শঙ্করের
ক্লোস আপ শট্ নীতার দৃষ্টিকোণ (পয়েন্ট অফ ভিউ)
থেকে। আমরা বুঝতে পারি
না তারা কোথায় আছে, তাঁদের অবস্থান কি। খুব অন্ধকার ঘরের অবস্থা, প্রায় কিছুই দেখা যায় না। শঙ্করের মুখ একদম পর্দার ডানদিকে, তাঁর চাহনি বাঁদিকে। একমাত্র তাঁর মুখের ওপর হাল্কা আলো, আর তাঁর পিছন থেকে হাল্কা
আলোর একটা রশ্মি আসছে যাতে মাথার চুলের অংশবিশেষ উজ্জ্বলিত।
দ্বিতীয় শট মিড ক্লোস আপ শঙ্করের। ক্যামেরার স্থান বদল হয়েছে। পর্দায় শঙ্করের অবস্থানও পরিবর্তন হয়েছে। ডানদিক এর পরিবর্তে এখন সে বাঁদিকে। এক্ষেত্রেও ঘরে তাঁর অবস্থান বোঝা যায় না।
শঙ্করের মুখের
কিয়দংশ হাল্কা আলোয় উজ্জ্বলিত। তাঁর সামনে একটা হ্যারিকেন। এবার বোঝা যায় তাঁর পিছনে বেড়া আছে। বেড়ার ছোটো ছোটো ফাকা দিয়ে হাল্কা আলোর অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তাতে কিছুই পরিবর্তন হয়নি শুধু আলোর অনুপ্রবেশ বেড়ার অস্তিত্বকে
প্রমান করেছে।
এরপর শঙ্কর এর
ঘাড় ঘোরানোর সাথে সাথে ক্যামেরারও পর্দার ডান দিক থেকে বাঁদিকে পার্শ্বপরিবর্তন হয়। পার্শ্বপরিবর্তন এর মাধ্যেমে নীতা ও শঙ্কর একই ফ্রেমে আসে,
এরপর নীতার মিড ক্লোস আপ এ এসে ক্যামেরা স্থির হয়। নীতার মুখের কিয়দংশ মনে হচ্ছে দূর থেকে আসা হাল্কা আলোয় উজ্জ্বলিত। তাঁর ঘাড় ঘোরানোর সাথে সাথে তাঁর মুখ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয় এবং
ঘাড়ের অংশটি সেই আলোয় উজ্জ্বলিত হয়। পুরো ঘর জুড়ে অন্ধকার শুধু নীতার ঘাড়ের ওপর আলো আর তাঁর ডানদিকের বেড়া দিয়ে
আলো ঢুকে তার অস্তিত্ব প্রমান করছে।
এই অংশে নীতার
ঘাড়ের ওপরই আলো ফেলা বাকিটা অন্ধকারাচ্ছন্ন রাখার মাধ্যমে পরিচালক কীসের ইঙ্গিত দিয়েছেন। সাধারনত আমাদের মত ছাপোষা বাঙালীদের সারা জীবনেও ঋত্বিক কুমার
ঘটককে জানা সম্ভব নয়। তাই আমরা নিজেদের আভিজাত্য ফলানোর দায় সর্বসমক্ষে বলে দিই “ও আবার কী জন্য এমনিই
করেছেন। বেশী টাকা ছিল
না তাই অমন অন্ধকারই রেখেছেন, আলোর ব্যবস্থা করতে পারেন নি হয়ত।" ওহে আমার অতি মূর্খ বন্ধু ছবি দেখা আর ছবি পড়া দুটো সম্পূর্ণ আলাদা। বিস্তর বিদেশী ছবি দেখলেই আর বিদেশী তারকার নাম জানলেই যদি
ছবি বোদ্ধা হওয়া যেত তাহলে সারা কলকাতায় এর সংখ্যা অনেক হত। তাই যারা কিছু হবে না কিছু ছিল না
বলে দাবি করে তাদের কাছে অনুরোধ দয়া করে এ কথা বলবেন না, আগে বাংলা ইতিহাস জানুন আগে
বাংলা ছবি বুঝুন তারপর অতি বড় চালাকের মতন মন্তব্য করবেন। আগে ছবির ভাষা বুঝুন মন্তব্য না হয় নাই করলেন।
ছবির শুরুর দৃশ্য
ও শেষের দৃশ্য এর তুলনা করা যায় তাহলে আমরা দেখতে পারি যে নীতার আগমন কোথা থেকে আর
প্রস্থান বা বিসর্জন কোথায় হয় তা আমরা জানি না। নীতাকে তাই এখানে এক ঐশ্বরিক রূপের সাথে তুলনা করা হয়েছে। আর আমাদের বাঙালীদের কাছে নারী রুপী ঈশ্বর বলতে দেবী দুর্গার
কথাই আগে ভেসে আসে। পরিচালকের কল্পনারুপী
দেবী দুর্গা হল নীতা।
এ সত্য প্রমান
করার জন্যেই পরিচালক এ দৃশ্যে নীতার গলার ওপরই শুধু আলো ফেলে। তাঁর গলার ওপর আলো ফেলার যে যৌক্তিকতা তা দেবী মূর্তি কে
প্রতিস্থাপিত করে। মূর্তি গড়ার সময়
মুখ থেকে গলার অংশটুকু ছাঁচে ফেলে করা হয়। দেহটুকু আলাদাভাবে গঠন করে ধড়ের ওপর বাকি অংশটুকু বসিয়ে দেওয়া হয়। তুলনামুলক ভাবে তাই সাধারন মানুষের
থেকে মূর্তির গলার অংশের দৈর্ঘ্য বেশী হয়। তাই নীতার গলার অংশের উজ্জ্বল রাখার পিছনে এ সত্যই প্রকট হয় যে পরিচালক এখানে
নীতাকে তুলনা করেছেন দেবীমূর্তির সাথে।
তৃতীয় শট এটা নতুন করে নেওয়া কোন শট নয়। আগের শটেরই দীর্ঘাইকরন। ক্যামেরার স্থান পরিবর্তন হয়। ক্যামেরা যেখানে ছিল সেখান থেকে দুজনকে একই ফ্রেমে এনে ট্র্যাক
ব্যাক করে এবং অনেকটা দূরে এসে স্থির হয়। দূরে নীতা ও শঙ্কর বসে আছে তাদের ওপর হাল্কা আলো শুধু তাদের অস্তিত্ব প্রমান
করছে। ক্যামেরার ফোকাস
তাদের ঘরের ছাদের ওপর। সিলিং এ হাল্কা আলো প্রতিফলন করে ফেলা হয়েছে। আমাদের কাছে এইবার তাদের ঘরের অবস্থাটা পরিস্কার হয়। এতক্ষণ বাদে আমরা বুঝতে পারি তাদের শারীরিক অবস্থানটা কোথায়।
ক্যামেরা কিছুক্ষন
স্থির থাকার পরেই আবার ট্র্যাক ইন করে একই ফ্রেমে দুজনকে রেখে স্থির হয়, দুজনের মিড
ক্লোজআপ শটে।
চতুর্থ শট এই দৃশ্যটাই অনেকের কাছে বোধগম্য নয়। কেন এই দৃশ্যে নীতার এক্সট্রিম ক্লোজআপ শট নেওয়া হল এবং নীতা
ছাদের দিকে তাকিয়ে গান গাইতে লাগল।
পরিচালকের কৃতিত্ব
সেখানেই যেখানে একটা ছবি পরিচালকের কল্পনাপ্রসূত হয়ে তা সক্ষম রূপ নেয় এবং তা স্বয়ং
পরিচালকের ছবি হয়ে দাড়ায়।
মেঘে ঢাকা তারায় এই দৃশ্য কোথায় পরিচালক বুঝিয়ে দেননি,এখানে
তিনি তাঁর কল্পনাকে বাস্তবায়িত করেছেন। ছবিটা শুরু থেকে দেখলেই বোঝা যায় এই অংশে এসে নীতার বিসর্জন ধীরে ধীরে আসতে
চলেছে। তাই বিসর্জনের
সমতুল্য কিছু দৃশ্যায়িত করার জন্যেই এই দৃশ্য।
নীতার ছাদের দিকে
তাকিয়ে থাকার দৃশ্যটা প্রতিমা বিসর্জনের সময় যখন নদীবক্ষে প্রতিমাকে ফেলা হয় সেই সময়
শুধুমাত্র তার মুখমণ্ডলীটাই জলের ওপরে ভেসে থাকে বাকীটা ডুবে যায়, এই দৃশ্যের সাথে
তুলনা করা হয়েছে।
দেবী প্রতিমা যেমন
কিছুদিনের জন্যেই আমাদের কাছে আসেন তেমনি নীতার জার্নিটাও কিছুটা সময়ের। ছবিতে পরিস্কার হয় না নীতার এর আগে কি ছিল, নীতারে এর পর
কী হবে। আমরা জানতে পারি
না নীতার শেষে কী হয়। দেবী প্রতিমার মতই নীতার আগমন ও বিসর্জনের কথা আমাদের কাছে রহস্যাবৃত থেকে যায়।
পঞ্চম শট শঙ্করের মিডক্লোজ আপ, তাঁর মুখের ওপর হাল্কা আলো,
পর্দার বাঁদিকে তাঁর চাহনি। শঙ্কর গান থামায় কিন্তু নীতা তখনও গান গেয়ে চলে, শঙ্কর তাঁর মুখের দিকে তাকায়,
এইখানেই এই শট শেষ হয়।
ষষ্ট শট নীতা এই দৃশ্যেও আগের মত ওপরের দিকে চেয়ে থাকে
এবং তাঁর পিছনে ঝাপসা দুটো আলোর উৎস উজ্জ্বলিত হয়ে থাকে।
এই দৃশ্যেও আরও
পরিস্কার ভাবে নীতাকে দেবীরূপে দৃশ্যায়িত করা হয়েছে তাঁর পিছনে দুটো উজ্জ্বল আলোর উৎস
দিয়ে। দেবীর পিছনে যেমন
একটা আলোর উৎস তাঁর দৈবিক রূপকে প্রকাশিত করে থাকে তেমনি এখানেও নীতার পিছনে একটা আলোর
উৎস তাঁর সাথে দেবীর তুলনাকে আরও দৃঢ় ভাবে প্রকাশিত করে।
এখানেই এই গানটির
শেষ হয়। গানের শেষ দুই
লাইনের সাথে সাথে চাবুকের শব্দ ও ভেসে আসে। ঋত্বিক বাবুর ছবিতে এই শব্দ এর প্রয়োগ যে কতটা গুঢ় অর্থবহন করে তাঁর আলোচনা
অন্য আরেকদিন করব আজ এইটুকুই থাক।
পরিশেষে ধন্যবাদ
সেই সমস্ত মানুষদের যাদের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ছাড়া এই লেখা অসম্ভব ছিল।
ধন্যবাদ।।
"যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে..." গানটির সুরকার শ্রী জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, এই অনবদ্য তথ্যের জন্য ব্লগ-লেখককে অভিনন্দন জানাই। সম্ভবত স্বয়ং কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র মহাশয়েরও অজানা এই তথ্য ভবিষ্যতের রবীন্দ্র-গবেষকদের নতুন করে অনুপ্রাণিত করবে এমন আশা রাখাই যায়...
উত্তরমুছুনঅসাবধানতায় খুব বড় একটা ভুল হয়েছিল ধরিয়ে দেওয়ার জন্যে ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুন