প্রথম বার কোনও শিশু শ্রমিক তৃতীয় লাইন থেকে গেয়ে
ওঠে
“ সারে জাহাসে আচ্ছা”
ফেলে দেওয়া, ভাঙাচোরার ডাস্টবিনের জিনিষ বাছাই করা ছেলে
, কাকুর কাছে থাকে নাম ‘গাট্টু’ । জানতে পারি সে অনাথ , বাবা মা নেই ঘিনেঘিনে
নোংরা গলিতে তার বসবাস কাকার সাথে। আর কাকা বাদে আর একটি প্রাণী তার কাছের “
টাইগার” , গাট্টুর প্রিয় ভেড়া। যার দিন শুরু হয় গাড়ির একটা ভাঙাচোরা সীট থেকে ,সে
বিছানা হিসাবে ব্যবহার করে, কাকুকে খাবার তৈরি করে সে কাবারি/দি বাছাই এর কাজে
লেগে পড়ে। কিন্তু আকাশে ঘুড়ি দেখলেই তার মন উত্তাল হয়। আর কাজের ঠিক থাকে না সে
বেরিয়ে পড়ে। সে অন্যদের সাথে খুব একটা মেসে না। ঘুড়ি ধরার থেকে ঘুড়ি ওড়ানোর দিকে
তার ঝোঁক অনেক বেশী। সে সরাসরি লড়াইতে আসতে চায় আকাশের উচুতে ওরা ঘুড়ি গুলির সাথে।
এখানেই আমরা পরিচিত হয় “ কালী” নামের এক শক্তিশালী ঘুড়ির সাথে। পরিচালক
প্রথম পাঁচ মিনিটেই হানা দেন আমাদের সব থেকে প্রিয় শৈশবে। আমরা একাত্ম হয়ে পড়ি
ছবির সাথে।
গাট্টু ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য মিথ্যা কথা বলে , টাকা চুরি করে
। নীল আকাশ তার কাছে নেশার মত। বার বার সে ঐ “কালী” ঘুড়ির সাথে অসম লড়াই তে হেরে
যেতে থাকে । আর প্রতিবার তার চোয়াল সক্ত হয় জেদ বেড়ে যায় নতুন প্রস্তুতি নিয়ে আবার
ঘুড়ি যুদ্ধে আসতে চায়। এই পর্বে আমাদের ভাষাতে গাট্টুর “ স্ট্রিট স্মার্টনেস” ফুটে
ওঠে দারুন ভাবে । সে পাড়ার দোকানদার এর মেয়েকে ডিভিডি এনে দেওয়া হোক বা পাড়ার
দর্জিরকে পোটিয়ে ছাদ পাওয়া হোক। এসবের মাঝেও কোথাও একটা নিজস্ব স্নেহ বোধ কাজ করে
যে কারনে সে তার পোষা ভেড়া যাকে টাইগার নামে ডাকে তাকে নিয়মিত দুধ খাওয়াতে ভোলে
না। আমরা ধীরে ধীরে গাট্টুর সাথে এক হয়ে যেতে থাকি যে কারনে টাকা চুরি করার মত
কাজেও হাত তালি দিয়ে ফেলি। আমাদের মননও গাট্টুর ওড়ানো ঘুড়ির সাথে উড়তে থাকে আকাশে।
ফলে দু একটা দৃশ্যে অতিপাকামিকে আশকারা দিয়ে ফেলি। কিন্তু পর্বের চেষ্টাও ব্যার্থ
হয়।
পরিচালক রাজন খোসা এখানেই আসল কাজটা করেন নিছক একটা ঘুড়ি
কেন্দ্রিক গল্পকে অন্য উচ্চতাতে নিয়ে ফেলেন । বিসন্ন গাট্টু জানতে পারে তার এলাকার
স্কুলের ছাদ সব থেকে উচু যদি শেখান থেকে ঘুড়ি ওড়ানো সম্ভব হয় তবে “কালি”কে কাটা
সম্ভব। কোনোদিন স্কুলে না পড়া গাট্টু এক অদ্ভুত চতুরতাতে ভর করে ভর্তি না হয়ে
স্কুলে ঢুকে পড়ে। সে নতুন জগতের খোজ পায়। প্রথম বার কোনও শিশু শ্রমিক তৃতীয় লাইন
থেকে গেয়ে ওঠে “ সারে জাহাসে আচ্ছা”। সে প্রথমবার জানতে পারে জন্মদিন নামে একটা
ব্যাপার আছে। ঘরে ফিরে কাকাকে প্রশ্ন করে “ কাকা আমার জন্মদিন কবে?” কাকা উত্তর
দিতে পারেন না । শুধু বলেন তোকে তোর বাবার থেকে কিনেছিলাম। এখন ঘুমিয়ে পর আর এসব
পাগলামি ছেড়ে মন দিয়ে কাজ সেখ । সিনেমা হল নিঃশব্দ হয়ে যায় হটাৎ। একজন গাট্টু নয় ,
লক্ষ গাট্টুর কথা এভাবে প্রকাশ হয়।
ছবিটি মহান বানী দানের ছবি হয়ে ওঠার তৃতীয় এবং সবথেকে
জোরালো সম্ভবনা কে বাদ দিয়ে এখান থেকে পরিচালক আবার ঘুড়ির গল্পে ফেরত আসেন । আমি
আপ্লুত হয়ে পাসে বসা ফিল্ম স্টাডিস পড়া আদিত্যর দিকে চোখ ইশারা করে জানিয়ে দি । এই
পরিচালক আমার প্রিয়তম পরিচালক দের তালিকাতে ঢুকে পরলেন। গাট্টু বুঝতে পারে ক্লাস
করতে হলে বই নামক বস্তুর প্রয়োজন হয়, সে সেটাও চুরি করে অন্যের ব্যাগ থেকে এবং
ধরাও পড়ে সহপাঠীদের হাতে । শেখান থেকে আবার অন্যভাবে বন্ধুত্বের শুরু হয় এ বারের
মত গাট্টু সাস্তির হাত থেকে বেচে যায়। যারা সালাম ডগ মিলিয়নিয়ার “ স্টোরি টেলিং”
পছন্দ করেছিলেন তাদের কিন্তু এছবিও ভালো লাগবে। গাট্টু শেষ পর্যন্ত স্কুলের ছাদে
যেতে সফল হয় এবং একই সাথে কাকার কাছে ধরা পড়ে যায় যে সে দীর্ঘদিন কাজ না করে
স্কুলে যেতে শুরু করেছে। প্রবল বকুনি জোটে। হায়-রে সর্ব শিক্ষা , হায়-রে শিক্ষার
অধিকার।
গাট্টুর জীবন কঠিন হয়ে ওঠে একদিকে নিজের ঘুড়ি ওড়ানোর
যুদ্ধ, একদিকে কাকার বকুনি, একদিকে বন্ধুত্ব একদিকে ভালো লেগে যাওয়া স্কুল একসাথে ঘুড়ির
প্যাঁচে আটকে ফেলে ছোট্টো ছেলেটাকে। যেমন আমরা আটকে পড়ি প্রতিমুহূর্তে জীবনের “কালি”র
সুতোর প্যাঁচে। গাট্টু কি পারল সফল হতে? এটুকু যারা দেখেননি
তাদের জন্য তোলা থাক। তোলা থাক রাজন খোসার মুন্সিয়ানা।
বরং কথা বলা যেতে পারে ঘুড়ি ওড়ানোর দৃশ্যের গ্রাফিক্স
নিয়ে। কথা হোক একটা ছোট্ট গল্পের মধ্যেকার এই “সময়” এর “ডকুমেন্টেশন” নিয়ে। কথা
হোক শিশু শিল্পী মহম্মদ সামাদ(গাট্টু) এর পুরো ছবি জুড়ে পা টেনে টেনে হাটার অভিনয়
নিয়ে। নরেশ কুমার হিসাবে গাট্টুর কাকাকে নিয়ে। তবুও এছবির অর্থনৈতিক সাফল্য নিয়ে
আমার কাছে কোনও খবর নেই।
তবে অন্য এক “দেখা” দেখলাম আমি, তা কিছুটা এরকম
২০
এপ্রিল ২০১২, শুক্রবার , খুব কম প্রচার করেই রিলিজ হয়েছিলো গাট্টু একটু ব্যাস্ততা
ছিল তাই ভেবেছিলাম ৩/৪ দিন পরে দেখব ছবিটা। কিন্তু আমার সময়ে যখন আমি পৌছলাম
দেখলাম শো টাইম পরিবর্তন হতে হতে দিন পিছু মাত্র একটা শো হচ্ছে। চিলড্রেন ফিল্ম তো
নাকি মার্কেট নেই।
২৮ ডিসেম্বর ২০১২, শুক্রবার , নন্দন চিলড্রেন ফিল্ম
ফেস্ট সেই সন্ধ্যা ৬ টায় শো কিন্তু বিকেল সাড়ে চারটে থেকেই ভীষণ লম্বা লাইন পড়েছে।
সবাই গাট্টু দেখতে এসেছেন। কতশত আলোচনা উঠে এলো শেখান থেকে কেউ বলছেন বিখ্যাত পরমাণু
বিজ্ঞানীর ছোটবেলার গল্প তো কেউ বলছেন কোনও এক মুম্বাই খ্যাত ডাক্তার এর ছোটো
বেলার গল্প। তখনও ঊশষী আসেনি ফলে আমি আর আদিত্য এসব উদ্ভট গল্প শুনছিলাম । সবটাই
বাচ্চাদের মা- বাবা দের তৈরি আসলে বুঝলাম এটা সেই সংক্রামক মানসিকতা যারা তাদের
বাচাকে একদিন সময় করে একাডেমিক এর বাইরে নিয়ে সেদিন এর গাট্টু দেখাতে নিয়ে যান নি।
সেটা হলে নিছক ঘুড়ি ওড়ানো একজন শিশু শ্রমিক এর কথা গল্পে কিছুতেই ডাক্তার ,
ইঞ্জিনিয়ার এর কথা আসতো না। মনটা খুব
আবেগপ্রবন হয়ে ওঠে পকেট থেকে সেল ফোন বের করে গাট্টুর পরিচালক রাজন খোসা কে মেসেজ
করি এই ভিড় এর কথা জানিয়ে। এতো মানুষ একসাথে কোলকাতাতে ওনার ছবি দেখতে ভিড় করেছে
জেনে উনি খুশি হয়ে শুভেচ্ছা বার্তা জানিয়ে মেসেজ করেন। রাতে কথা হবে এই মর্মে।
প্রযোজক- চিলড্রেন্স ফিল্ম
সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া
পরিচালক – রাজন খোশা
চিত্রগ্রহণ- সত্য রাই
নাগপাল
অভিনয়- মহম্মদ সামাদ , নরেশকুমার
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন