বৃহস্পতিবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

বাইসাইকেল কিকঃ এক ইছেপূরনের গল্প।


 
 
এক ঝাঁক ইচ্ছেরা কড় গুনে গুনে স্বপ্ন দেখে। ভবিষ্যতের রংমশাল নিজেরাই মনের মধ্যে জ্বালায়। কখনও সেই রঙিন আলো নিভে গেলে ম্যাজিশিয়ানের আবির্ভাব হয়, আর তার রুপোকাঠির ছোঁয়ায় রাস্তারা আবার আস্তানা খুঁজে পায়।

ঠিক এইভাবেই স্বপ্ন দেখত রুবায়েত। তার ইশারায় জীবন চলবে, তিন কাঠির বেড়াজালে বল গিয়ে আছড়ে পড়বে বারবার। আর এই ভাবেই বহুদিন আগে স্বপ্ন দেখত মতিদা। দুটো স্বপ্ন এক, দুটো ইচ্ছে এক, শুধু সময়টা আলাদা, আলাদা প্রেক্ষিত, তাই ইচ্ছেপূরনের গল্পটা আর এক থাকে না, সময়ের সাথে সাথে সেটাও বদলে যায়, আর বদলে যায় বলেই দুটো স্বপ্ন এক হয়ে যায়, দুটো ইচ্ছে এক হয়ে যায়, দুটো মন এক হয়ে যায়, ফারাক শুধু একটাই একটা মনে আর একটা মনের প্রবেশ ঘটে। বহুবছর আগে হারিয়ে যাওয়া ইচ্ছেরা, মানুষটা আবার খুঁজে পায় এই তরুণ উচ্ছ্ব্ল বালকটির মধ্যে। স্বাধীন ভাবে তাই স্বপ্নরা বেঁচে থাকে, স্বাধীন ভাবে তাই পোশাক পড়ে নেমে পড়তে হয় ময়দানে, সবুজ ঘাসগুলো সাদরে আহ্বান জানায়। “বাই সাইকেল কিক”, দেবাশিস সেনশর্মা ও সুমিত দাস পরিচালিত নতুন বাংলা ছবি ঠিক এই স্বপ্নের গল্প, এই ইচ্ছের গল্প।

সত্যিই তো যদি ইচ্ছেডানায় ভর করে পক্ষীরাজ তাহলে তো ডানা মেলে উড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। তাই তো রুবায়েত এর জোরালো শট তিনকাঠি পেরিয়ে বেড়াজালে বন্দি হয়, আর তখনই পায়রাগুলো আবার ঘরে ফেরার তাগিদে সবাই একসঙ্গে উড়ে যায়, উড়ে যায় মন, উড়ে যায় ভালবাসা, উড়ে যায় বহুদিনের জমে থাকা ইচ্ছেরা।

বাংলা সিনেমা তার বেডরুম থেকে বেরিয়ে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। কখনও উত্তর কলকাতার অলিতে গলিতে বা কখনও কোন গ্রামবাংলার লালমাটিতে ঘুরে বেরায়। দৃষ্টিকোণে জমা হতে থাকে আমার শহর, আমার বাংলার পুঞ্জিভূত স্রোত। স্বাধীন চিত্রপরিচালকদের কাছে সমস্যা ঠিক এইখানেই, সীমিত বাজেটে ছবি বানানো। যেখানে অনেক ইচ্ছে অধরাই থেকে যায়। কিন্তু এই সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও কিভাবে গল্প পরিবেশক দর্শক মনে উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করে, বাই সাইকেল কিক তার উদাহরণ।

শুধুমাত্র ঝাঁ চকচকে লোকেশন, আর দামি অভিনেতা অভিনেত্রী ছাড়াও যে, গল্পের জোড়ে, সংলাপের জোড়ে, দৃশ্যগ্রহণের জোড়ে, সম্পাদনার জোড়ে সর্বোপরি পরিচালনার জোড়ে ছবির অধিকাংশ তাত্ত্বিকতাকে মেনে, ছবিকে সম্পুর্ন আলাদা একটা মাধ্যম হিসাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার ইঙ্গিত, ও তদপরি নিজের প্রয়াসের ছাপ রেখে যাওয়ার ব্যবহার বাংলা ছবিতে নতুন একটা দিগন্তের উন্মোচন করে। যেখানে থিওরি আর টেকনিক মিলে যায়।

কবিতা কখনও ছবির ভাষা হতে পারে, কবিতার তো স্বকীয়তা আছে, তবু কেন সে ছবির ভাষা হবে, ছবির তো নিজস্ব ভাষাই আছে, যা নিয়ে সেই প্রাচীন যুগ থেকে তর্ক চলেই আসছে। কিন্তু একটা ছবিতে যদি কোন দৃশ্যকাব্য রচনা হয়, যদি আমি সংলাপের বদলে কবিতা দিয়ে প্রেমের ছবি আঁকি তাহলে? তাহলে আমি একটা ছবির মধ্যে দিয়ে একটা কবিতা বলতে পারি। দুটো মাধ্যম সম্পুর্ন আলাদা হয়েও মিশে যেতে পারে একে ওপরের সাথে। তাই তো ছবির মধ্যগগনে ক্যামেরা যখন প্রবেশ করে শহরের আনাচ-কানাচ থেকে সবুজ বাংলার এবড়োখেবড়ো মেঠো পথে, তখন তার রূপ কবিতা হয়ে ঝড়ে পড়ে পর্দার ওপরে।

বাস্তব জীবনে রুপকথার পরি আসে, তার কানেকানেও জোনাকি গুনগুন করে, ভালবাসা ফুচকার জল পেরিয়ে পারি দেয় জীবন দেখানোর ছন্দে। যেখানে রাজকন্যা এলচুলে মাতোয়ারা হলে সন্ধ্যে ঘনিয়ে বৃষ্টি নামে। শহরের বুক থেকে চুইয়ে চুইয়ে পড়ে ভালোবাসার গন্ধ মাখা জল। আর মাধবীলতা যখন অতুলপ্রসাদের সুর তোলে তখন ঘরময় এক নিস্তব্ধতা প্রবেশ করে যা চেনা মুখগুলোকে খানিক্ষনের জন্যেও ভাবের জগতে প্রবেশ করায়।

নতুন ভাবে নতুন আঙ্গিকের কথা যদি বলতেই হয় তা হল এই ছবির দৃশ্য, প্রচণ্ড রঙিন অবায়ব, চারপাশের পরিবেশও যেন রঙ মেখে অপেক্ষা করছে ফ্রেমে উপস্থিত চরিত্রদের সাথে। ছবির দৃশ্যের সাথে সাথে ছবির সম্পাদনাও নতুন মাত্রা যোগ করে। একটা দৃশ্যের পর অপর একটা দৃশ্য ব্যবহার ও সেই সাথে ক্যামেরার ব্যবহার, তার স্থানবদলের  প্রয়োগ রীতি যেন প্রতিটা ফ্রেমকে দৃশ্যবহুল ও অর্থবহ করে তুলেছে। এছাড়াও ছবিতে ব্যবহৃত স্থায়ী ও অস্থায়ী উপাদান যা এক একটা ফ্রেমের অর্থকে আরও গাড় করে প্রকাশ করে। এর প্রমান মেলে খুব ভালভাবে রাশিয়ান পুতুলের ব্যবহারিকতায়। মনের মধ্যে মন, অন্যমন, অন্যমনস্কতার সিম্বোলিক পরিচয়।

ছবির চরিত্র চিত্রণের ক্ষেত্রে প্রথমেই নজর কাড়ে, টেনিদা ও তার পালের ব্যবহার। যারা আজও ওই উত্তর কলকাতার রক গুলোকে জমিয়ে রাখে, আর কেউ বিপদে পড়লেই চিৎকার করে বলে ওঠে, ডি লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফেলিস......... ইয়াক...ইয়াক। এছাড়া আর যার কথা না বললে লেখাটাই অধরা থেকে যায় সে হল মতিদার চরিত্রে অভিনয় করা ঋত্বিক। তার কেরিয়ারে নবতম সংযোজন এই চরিত্র। যা এককথায় অনবদ্য। তাই বাধ্য হয়েই মনে থেকে যায় পর্দায় তার উপস্থিতি, ইচ্ছের সাথে এগিয়ে চলার ইচ্ছেপ্রসন।

পরিশেষে বলতেই হয় ছবির সঙ্গীত ও আবহসঙ্গীতের কথা। গানের কথা আর দৃশ্যের পিছনে ব্যবহৃত আবহসঙ্গীত ছবিকে অন্যমাত্রায় নিয়ে যায়, তাই পরতে পরতে যখন এক একটা দৃশ্যের পিছনে শব্দের বা সঙ্গীতের ব্যবহারিক প্রয়োগ ঘটে তখন সেই দৃশ্যের মাহাত্ম্য অনেকটা গূঢ় হয়, চোখের সাথে সাথে কানেও উপলব্ধ হয়। তাই চোখ বুজেও মাঝে মাঝে সেই সুগন্ধটা পাওয়া যায়।

বাইসাইকেল কিক এক নবতম উদ্যোগ বাংলা ছবির জগতে, এক ইচ্ছেপ্রসনের স্বাধীনতা, মাধবীলতা, আর রুবায়েতের গল্প, মতিদার স্বপ্নপূরণের হাতছানি, সিধু জ্যাঠার দাবার চাল, পটলডাঙার অস্তিত্ব, ফুটবল থেকে বল গরিয়ে গোল আর ম্যাজিশিয়ানের রূপোকাঠির ছোঁয়ায় বাস্তবতা আর রূপকথার মেলবন্ধন, এসবের সংকলন।
(সম্পাদনাঃ অনুসুয়া চন্দ্র)

ছবিঃ বাইসাইকেল কিক

অভিনয়ঃ সৌরভ, রিধিমা, ঋত্বিক, সৌমিত্র চ্যাটার্জি প্রমুখ।

সঙ্গীতঃ জয় সরকার।

আবহসঙ্গীতঃ মৈনাক বাম্পি নাগ চৌধুরী।

পরিচালনাঃ দেবাশিস সেনশর্মা ও সুমিত দাস।     

সোমবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

অবিরত, চলন্ত সাইকেল আর জীবন।


 
 
 
ঠিক ২৫ বছর আগে যখন আফগানিস্থানের থেকে রাশিয়া ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছে তখন আর এক লড়াই এর কথা বলছেন ইরানীয়ান পরিচালক মহাসিন মাখমাল বাফ সাইকিলিস্টএর মাধ্যমে। একজন আফগান রিফিউজিকে নিয়ে কিভাবে যেন একটা লড়াই আজও ছড়িয়ে দিচ্ছেন আমাদের মত মানুষদের মধ্যে।

নাসিম এর অসুস্থ স্ত্রীকে সুস্থ করবার জন্য টাকা প্রয়োজন । এই টাকা জোগাড় করতে নাসিম কে সারা শহর ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে । ততদিনে নাসিমের কুয়ো খোঁড়ার পেশাতে ভাটা আসতে শুরু করেছে। নাসিম কুয়ো খোঁড়া বাদে আর সাইকেল চালাতে পারে মাত্র। এই সাইকেল চালানোকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করে সাইকিলিস্ট ছবি। বদলে যেতে থাকে পরিবেশ। নাসিম এর আগে তিনদিন একটানা সাইকেল চালিয়েছে, কিন্তু এবার তাকে জুয়াড়িদের দাবি অনুযায়ী সাত দিন চালাতে হবে। আমাদের মত সাধারন মানুষের প্রশ্ন যখন এই আঙ্গিকে পড়ে থাকে, তখন আমারা এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য ছবিটি দেখতে বসি। ধীরে ধীরে আশির দশকের শেষদিকের আফগান-ইরানের বৃহত্তর রাজনৈতিক-সামাজিক ছবি আমাদের মস্তিস্কে চালান করেন পরিচালক ।


যেখানে ধীরে ধীরে আফগান রিফিউজি বাড়ছে যাদের দেশে খাবার নেই বিদেশে কাজ নেই। এই নাসিম তো তাদের একজন যাকে যেকোনো মূল্যে বাঁচতে হবে। আর একটা শ্রেণির ইরানিয়ান মানুষ যারা তেলের খনির লোভে বালিতে কুয়ো খুড়তে এই নাসিমদের ভাড়া করে। বিস্তর অর্থনৈতিক ফারাক এই দুই শ্রেণির মধ্যে । যারা শখে জুয়া খেলে বাজি ধরে লক্ষ লক্ষ টাকা এই নাসিমরা কতক্ষণ একটানা সাইকেল চালাবে। তারপর, নাসিম কে ঘিরে কার্নিভাল গড়ে ওঠে যেন কোনও জ্যান্ত বন্যপশুর রিং এর খেলা দেখানো হবে এমন ভাবে। শিউরে উঠি যখন গভীর রাতে সারা শহর ঘুমিয়ে পড়ে , জুয়াড়িরা দামি গাড়িতে আরাম করে তখন নাসিম অল্প টাকার জন্য অক্লান্ত সাইকেল চালাতে থাকে। শীত বাড়লে কুঁকড়ে থাকা ছেলেকে যখন গায়ের একমাত্র চাদরটা ছুড়ে দেন তখন দারিদ্রতা পেরিয়ে উঠে আসে বাবা, বা যখন ছেলের আনা ফুল শুঁকে নাসিম হেসে ওঠে তখন কিছুটা সময়ের জন্য মনে হয় এই রিফিউজি নাসিম না হয় ছেলে কে পেয়েছে, বাকি হাজার হাজার নাসিম কি করছে?
সাতদিনের নাসিমের চলার পথ কোনভাবেই সুখের না, কখনো বিরোধী পক্ষের ছড়ানো আলপিন তার সাইকেল অকেজো করে, তো কখনো গুন্ডা সর্দারের ফোনে হুমকি আসে। হঠাৎ বৃষ্টি নামলেও সে থামতে পারে না তাকে চক্রাকারে ঘুরতেই হয় একটানা।
 
 
 
 
 
 
 
 
এই চক্রাকারে ঘোরা শুধু মাত্র সাইকেল চালানো নয়, এটা জীবন বৃত্ত। যেখানে নাসিমদের মত ঘরহীন দেশহীন মানুষদের ঘুরে যেতে হয়। নাসিম কোনও কিছুতেই টলে না , মৃত্যু ভয় তাকে ছোঁয় না, কারণ সে জানে শারীরিক ভাবে সে বেঁচে থাকলেও সমাজের কাছে পরিসংখ্যান গত ভাবে সে মৃত।


তবে ধীরে ধীরে ক্লান্তি নাসিমকে গ্রাস করে। একই সাথে সাত দিনের মেয়াদ শেষ হওয়ার সময় এগিয়ে আসে । বাড়তে থাকে নাসিমের অসুবিধা । সে সাইকেল চালাতে চালাতে দেখে যে কত শত আফগান রিফিউজি কুয়ো খোঁড়ার কাজ পেয়ে চলে যায় । এ অবস্থায় নাসিমকে আক্ষেপ না করতে দেখে আমি বিস্মিত হই। কিন্তু যখন দেখি সেই শ্রমিকরা টাকার জন্য বিদ্রোহ করে তখন বুঝি নাসিম কেন আক্ষেপ করেনি।


নাসিমের নামে রূপ কথা প্রচার হতে থাকে সে নাকি ভারতে হাত দিয়ে ট্রেন থামিয়েছে , যতদিন এগোতে থাকে নাসিমের পক্ষে জুয়ার লগ্নি তত বাড়তে থাকে। তাতে নাসিমের কোনও হেলদোল বাড়ে না। কারন নাসিম জানে তাকে খুব সামান্য টাকা দেওয়া হবে। শেষের দিন এর সিনেম্যাটিক ভাবনা এবং তার প্রকাশ ভঙ্গি যেকোনো মানুষের চোখে জল এনে দেবে । যখন ঘুম আটকাতে নাসিম দুচোখের পাতাতে আলপিন আটকে সাইকেল চালাতে থাকে । তখন ওই আলপিন কি কোনভাবেই যুদ্ধবাজদের দুচোখে ফুটিয়ে দেন না পরিচালক? বা প্রায় অচেতন নাসিমের মুখে যখন তার নিজের ছেলে এক এর পর থাপ্পর মেরে তাকে জাগিয়ে রাখবার চেষ্টা করে তখন কি ওই থাপ্পর গুলো গিয়ে পড়ে না রাষ্ট্রনায়ক দের মুখে , যারা সীমানা নির্ধারণ বা শান্তির খোঁজে যুদ্ধ করে। হ্যাঁ পিন ফোটে দু চোখের রেটিনা জখম হয় , থাপ্পর সজরে পড়ে শক্তিশালী মানুষদের মুখে। আর পড়ে বলেই আজ ২৫ বছর পর বাংলার গ্রামে বসা একটা ঋত্বিক ঘটক পাগল ছেলে ইন্টারনেটে তন্ন তন্ন করে খুজে এই ছবির প্রেক্ষিত খুজে না পেয়ে পাগলের মত লিখতে শুরু করে। রিফিউজি যন্ত্রণা নিয়ে ছবির কেন কোনও সৎ ব্যাখ্যা থাকেনা? কেন? কেন আপসহীন মানুষ গুলকে নিয়ে আপোষ করে পরের দিকে কিছু ভেকধারি?


নাসিম তো আপোষ করে না জেতার আনন্দে মাতে না , তার চারিদিকে অজস্র টিভি ক্যামেরা দেখে সে উচ্ছাস প্রকাশ করে না। নাসিমের সাতদিন পূর্ণ হয়ে যায় নাসিম তাও থামেনা । আসলে সে থেমে করবে টা কি? তাকে রিফিউজি জীবনের বৃত্ত আষ্টেপৃষ্টে বেধে ফেলেছে। সে জানে এই ঘূর্ণি থেকে বেরলে অন্য কোনো ঘূর্ণি তার জন্য অপেক্ষা করছে। পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যায় এক মিলিয়ন আফগান রিফিউজি আছেন ইরানে। আর অবাক হয় না কুর্নিশ জানাই পরিচালক বাফকে। কুর্নিশ করি গার্ডেনার ছবির জন্য। কুর্নিশ করি আমাকে সাহস দেওয়ার জন্য।



ছবিঃদ্য সাইকেলিস্ট

পরিচালকঃ মহাসিন মাখমাল বাফ।


মঙ্গলবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

মধ্যরাতের শিশুদের ম্যাজিকের মোহভঙ্গ



সেলিব্রিটিদের প্রধান বৈশিষ্ট্য যদি বলা হয় তাহলে প্রথমেই আসে যে তারা সবসময় বিতর্কে থাকতে পছন্দ করে। বিতর্কই তাদের লাইমলাইটে তলায় এনে দার করায়। কিন্তু যে বিতর্কের আগুন বহুদিন ধরে চলছে, যে বিতর্ক সরকার পাল্টালেও বদলাও না। সেকি শুধুই কিছু উগ্র মৌলবাদীদের ঔদ্ধত্য ফলানোর জন্য না এর পিছনেও গভীর রাজনৈতিক চাল আছে। সেসব অতীব চালাক ব্যক্তির পক্ষ্যেও সহজে বোঝা সম্ভব নয়। আমাদের মত মুর্খের পক্ষে তো নইই। কেননা আমরা তো গণতন্ত্র বুঝতে শুধুমাত্র ভোটদান পর্বকেই বুঝি। থাক সেসব জটিল আলোচনায় গিয়ে লাভ নেই। মুল আলোচনায় ফিরে আসাই ভাল। কিন্তু এসব ভাবার একমাত্র কারন হল বঞ্চনা। কেন আমরা সাধারন মানুষ বারবার কিছু নিষ্ঠুর অসামাজিক দায়বদ্ধহীন মানুষের জন্য বঞ্চনার স্বীকার হব। কেন ২০০৭ সালের নভেম্বরে বিদেশী লেখিকাকে রাজ্যহীন করা হবে, কেন একজন সাধারন মানুষ সেই দিনে আর্মিদের অজস্র প্রশ্নের উত্তর দেবে, কেন সর্বদা একটা ভয় নিয়ে সেদিন কোথাও যেতে হবে, শুধুমাত্র সে প্রতিষ্ঠান বিরোধী লিখেছে বলে? এ প্রশ্নের কোন উত্তর হয় না কারন সেই ট্র্যাডিশন আজও ক্রমবর্তমান। শুধু একরাশ কালো অন্ধকার আমাদের গ্রাস করে নেয়। ইচ্ছে গুলোকে নেতিয়ে দেয়, স্বপ্নকে দুঃস্বপ্নে পরিনত করে।
অনেক আগেই শুনেছিলাম যে এবারের বইমেলায় সাহিত্য আলোচনা সভার মূল বিষয় “ছবি”। সিনেমার ছাত্র হিসাবে তাই খানিক আগ্রহই বেড়ে গিয়েছিল। আরও বাড়ল যখন সলমন রুশদি তার উপন্যাসের চলচ্চিত্রকরন নিয়ে আলোচনা করতে আসবেন পরিচালক দীপা মেহেতাকে সঙ্গে নিয়ে। কিন্তু হল না। রাজ্যে তাকে প্রবেশ করতে দেওয়া হল না। সরকারি ভোট ব্যাঙ্ক বহাল তবিয়তেই রইল। শুধু আলোচনা সভাটাই ভেস্তে গেল। তাই খানিক বিমর্ষ হয়েই চলে গেলাম “ মিডনাইটস চিলড্রেন” দেখতে। পকেটে টাকার অভাব এ যাত্রায় খানিক বাচল খয়েরি মানিব্যাগের সৌজন্যে।
গোটা ছয় মানুষ সারা সিনেমাহল জুড়ে। আমরাই মনে হয় একমাত্র যারা সিনেমাটাই সত্যি দেখতে এসেছি। পপকর্ন খেতে বা গলা জড়িয়ে বান্ধবীর সাথে গল্প করতে নয়। উপন্যাস পড়ার সৌভাগ্য হয় নি। এমনিতেই ভীতু তার ওপর আবার ৬০০ পাতার গভীর একটা ইংরাজি উপন্যাস। সে যাই হোক ৬০০ পাতা না হয় না পড়লাম কিন্তু ১৩০ পাতার চিত্রনাট্যের চিত্ররূপ দেখলাম। যেহেতু প্রেক্ষাপট স্বাধীনতার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ভারতীয় সমাজ। তাই সহজ ভাবেই বলা যেতে পারে যে ছবির দৃশ্য গ্রহণ পুরোটাই ভারতে গৃহীত হবে। কিন্তু মৌলবাদী চিন্তাবিদদের আক্রমণের প্রভাবে ও উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের অমসৃণ আচরনের ফলে ছবির অধিকাংশ দৃশ্য গৃহীত হয়েছে শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে, উইন্ডস অফ চেঞ্জ ছদ্মনাম দিয়ে। তাও ছবির দৃশ্য গ্রহণ বন্ধ ছিল যখন ইরান শ্রীলঙ্কার সরকারের কাছে ছবির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। পরে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট এর হস্তক্ষেপে ছবির দৃশ্য গ্রহণ আবার পুনরায় শুরু হয়।
সলমন রুশদি এখানে ছবির বিবরক। তার গলায় তার ভাষায় তার শব্দে আমরা গল্প শুনি। ছবির চিত্রনাট্য ও তার লেখা। এখানেই আসল মুশকিলটা হয়ে গেছে। রুশদি নিজে তার ৬০০ পাতার উপন্যাসকে ২ ঘণ্টা ২৮ মিনিটের পর্দায় চিত্রায়িত করার সময় তিনি ছবির কোন ঘটনাকে প্রাধান্য দেবেন আর কোন ঘটনাকে সুক্ষ ভাবে এরিয়ে যাবেন তিনি বুঝতে পারেন নি। লেখক-চিত্রনাট্যকেরের মধ্যে এটাই সমস্যা যে তিনি একবারও তার গল্প থেকে বেরোতে পারেন না। চিত্রনাট্যও তাই এক্ষেত্রে গাল্পিক হয়ে গেছে। সাহিত্যাকারে গল্প আমরা পর্দায় দেখি। সিনেমার ভাষা আর সাহিত্যের ভাষা কে এক্ষেত্রে আলাদা করা যায় না। তাই প্রায় ৪৫ মিনিট লাগে পরিচালকের ছবির সব চরিত্রকে স্বকীয় ভাবে স্থাপন করতে।
ছবির একটা বড় অলঙ্কার হল সময়। ১৯১৭ থেকে ১৯৭৭ সাল অবধি সময়কে এখানে ধরা হয়েছে। এই সময়ের ব্যাবধানে যা যা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে সবই ছবির এক একটা অঙ্ক। স্বাধীনতা, পাকিস্থানের গৃহযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ, এমারজেন্সি ইত্যাদি সব। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলি আমার মনকে ছুঁয়ে যায় নি। আমি স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে জাতীয় সঙ্গীতের সময় উঠে দাড়িয়ে বীরত্বে বুক ফুলিয়ে উঠিনা। জয় বাংলা স্লোগান আমায় উজ্জিবিত করে না। করবেও না। কারন ছবির যে অংশে এসে মুক্তিযুদ্ধ আসে বা এমারজেন্সি সেই সময়টার পর্দার উপরিস্থ দৃশ্য বড় প্রাণহীন। মৃত ব্যক্তির দেহ সবুজ বাংলার মাঠে শুইয়ে দিলেই আর মুজিবর রহমানের ছবি দিলেই কি প্রাণহীন ওই দেহ গুলির ওপর ভার্চুয়াল প্রাণের সঞ্চার হয়। যেমন ছবির চরিত্র গুলোর মধ্যেও প্রাণের বড় সমস্যা। কে প্রাধান্য পাবে আর কে না সেটা বোধহয় পরিচালক গুলিয়ে ফেলেছেন। তাই মূল প্রটাগোনিস্ট নিজের মুখেই কখনও বলে ওঠে তার ঠাকুরদা ঠাকুরমার প্রেম কাহিনী। যে গুলো নিছক অবাঞ্ছনীয়। কোন প্রয়োজন ছিল না ছবির সাথে তাল মিলিয়ে এই অংশকে পর্দাস্থিত করার। বরং যেটা বেশি প্রয়োজন ছিল সেটা হল ছবির প্রাণ ভোমরা যেখানে লুকিয়ে আছে সেই ম্যাজিক রিয়ালিজম এর অংশকে।
সেলিম ১৪ই আগস্ট, ১৯৪৭এ রাত ১২ টা বেজে জন্ম নেয়। বড় হওয়ার সাথে সে নতুন এক দিকের কথা জানতে পারে। নাকের সর্দি যখন টানে তখনই তার সামনে সেই সব চরিত্ররা এসে হাজির হয় যারাও সেই মধ্যরাতে জন্ম নিয়েছিল। তারা আলোচনায় বসে, কনফারেন্স করে, নতুন ভাবে সমাজকে সাজানোর স্বপ্ন দেখে। কিন্তু পরক্ষনেই সেই স্বপ্ন হারিয়ে যায় আর ছবি তত গতিহীন হয়ে যখন এই ম্যাজিক চরিত্রগুলি বাস্তবে ফিরে আসে, আবার আবরা-কা-ডাবরা বলে জ্যান্ত মানুষকে ভ্যানিস করে সীমান্তের বেড়াজাল টপকায়। যেখানে স্থান পায় ব্ল্যাক ম্যাজিক, পরকীয়া প্রেম আর তদুপরি সমসাময়িক রাজনীতি। যে রাজনীতির স্বীকার এই মধ্যরাতের শিশুরাও, সুস্থ সময় ফিরিয়ে আনার তাগিদে তাদেরও  জেলবন্দী করা হয়। কিন্তু যার আদেশে যে করে সেও তো ওই মধ্যরাতেই জন্ম নিয়েছিল, তাহলে সে পার পেয়ে যায় কি করে? যে বন্দীকরন আসলে সাম্প্রদায়িক পরস্থিতিকে কটাক্ষ করার জন্য লেখা হয়েছিল সেই বন্দীকরন ছবির এই পর্যায়ে এসে খাপ খায় না। মেনে নেওয়া যায় না ম্যাজিক এর গল্প বাস্তবে ফিরে এসে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়।
ম্যাজিক রিয়ালিজম, আসলে ম্যাজিকের আঙ্গিকে বাস্তব পরিস্থিতিকে কটাক্ষ করা। যেমন ফারনান্দো সোলানাস তার জার্নি ছবিতে তুলে ধরেছেন। কমিক বইয়ের চরিত্ররা বাস্তবে এসেও তাদের কমিক আঙ্গিকটা ঠিক ধরে রেখেছিলেন। বাস্তবে এসেও তারা ম্যাজিকের চরিত্রর মতনই ছিল। আলাদা ভাবে বাস্তবে মিশে যাই নি। বরঞ্চ সুকৌশলে তারা বাস্তব পরিস্থিতিকে কটাক্ষ করেছেন। এখানে পার্বতী বা অন্য কেউ কোন ভাবেই পারে নি। তারা বাস্তবেও বড়ই অমসৃণ হয়ে আছে। সেলিমের জার্নি আর সোলানাসের জার্নি তাই বিষয়গত ভাবে ম্যাজিক রিয়ালিজমের ওপর ভিত্তি করে চললেও কখনই সমান্তরাল ভাবে এগোতে পারে নি একে ওপরের সাথে। ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে।
চরিত্রদের মধ্যের দ্বন্দ্ব, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে তাদের উদ্বেগ এসবও ছবিতে থাকে না। আসলে দুর্বল চিত্রনাট্যে চরিত্ররা প্রাণ পায় না। সঙ্গীত দিয়েও তাদের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করা যায় না। ছবির সঙ্গীতও বড়ই দুর্বল তাই। দৃশ্যকে দর্শকের মনে গেঁথে নেওয়ার ক্ষেত্রে সঙ্গীত কোন ভাবেই সাহায্য করতে পারে না।
পরিশেষে বলতেই হয় যে এক ঝাক অভিনেতা অভিনেত্রীদের দুরন্ত অভিনয়, পরিচালকের সহজাত বুদ্ধিমত্তা সত্ত্বেও “মিডনাইটস চিলড্রেন” মধ্যরাত্রির গগনে ধ্রুবতারা হয়ে দিক দেখাতে অক্ষম। যে ম্যাজিক উপন্যাসে স্থান পেয়ে ৩৩ বছর আগে রুশদিকে বুকার পুরস্কার এনে দিয়েছিল সেই ম্যাজিক দীপা মেহেতার হাত দিয়ে আজকের বাস্তবে এসে ম্যাজিকের রূপ নেয় না। বড়ই সোজা সাপটা ভাবে একটা বড় সময়কে পর্দায় ধরা ছাড়া আর কিছুই করতে সক্ষম হয় না।

ছবিঃ  মিডনাইটস চিলড্রেন।
পরিচালকঃ  দীপা মেহেতা।
প্রযোজনায়ঃ  ডেভিড হ্যাম্লিন্টন, ডগ ম্যাঙ্কফ, স্টিভেন সিলভার, নেইল টাবাজনিক প্রমুখ।
অভিনয়ঃ  সত্য ভব, শ্রেয়া সরেন, সিদ্ধার্থ, সাবানা আজমি, রজত কাপুর, অনুপম খের, রাহুল বোস, সাহানা গোস্বামী, দর্সিল সাফারি প্রমুখ।