সোমবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

অবিরত, চলন্ত সাইকেল আর জীবন।


 
 
 
ঠিক ২৫ বছর আগে যখন আফগানিস্থানের থেকে রাশিয়া ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছে তখন আর এক লড়াই এর কথা বলছেন ইরানীয়ান পরিচালক মহাসিন মাখমাল বাফ সাইকিলিস্টএর মাধ্যমে। একজন আফগান রিফিউজিকে নিয়ে কিভাবে যেন একটা লড়াই আজও ছড়িয়ে দিচ্ছেন আমাদের মত মানুষদের মধ্যে।

নাসিম এর অসুস্থ স্ত্রীকে সুস্থ করবার জন্য টাকা প্রয়োজন । এই টাকা জোগাড় করতে নাসিম কে সারা শহর ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে । ততদিনে নাসিমের কুয়ো খোঁড়ার পেশাতে ভাটা আসতে শুরু করেছে। নাসিম কুয়ো খোঁড়া বাদে আর সাইকেল চালাতে পারে মাত্র। এই সাইকেল চালানোকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করে সাইকিলিস্ট ছবি। বদলে যেতে থাকে পরিবেশ। নাসিম এর আগে তিনদিন একটানা সাইকেল চালিয়েছে, কিন্তু এবার তাকে জুয়াড়িদের দাবি অনুযায়ী সাত দিন চালাতে হবে। আমাদের মত সাধারন মানুষের প্রশ্ন যখন এই আঙ্গিকে পড়ে থাকে, তখন আমারা এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য ছবিটি দেখতে বসি। ধীরে ধীরে আশির দশকের শেষদিকের আফগান-ইরানের বৃহত্তর রাজনৈতিক-সামাজিক ছবি আমাদের মস্তিস্কে চালান করেন পরিচালক ।


যেখানে ধীরে ধীরে আফগান রিফিউজি বাড়ছে যাদের দেশে খাবার নেই বিদেশে কাজ নেই। এই নাসিম তো তাদের একজন যাকে যেকোনো মূল্যে বাঁচতে হবে। আর একটা শ্রেণির ইরানিয়ান মানুষ যারা তেলের খনির লোভে বালিতে কুয়ো খুড়তে এই নাসিমদের ভাড়া করে। বিস্তর অর্থনৈতিক ফারাক এই দুই শ্রেণির মধ্যে । যারা শখে জুয়া খেলে বাজি ধরে লক্ষ লক্ষ টাকা এই নাসিমরা কতক্ষণ একটানা সাইকেল চালাবে। তারপর, নাসিম কে ঘিরে কার্নিভাল গড়ে ওঠে যেন কোনও জ্যান্ত বন্যপশুর রিং এর খেলা দেখানো হবে এমন ভাবে। শিউরে উঠি যখন গভীর রাতে সারা শহর ঘুমিয়ে পড়ে , জুয়াড়িরা দামি গাড়িতে আরাম করে তখন নাসিম অল্প টাকার জন্য অক্লান্ত সাইকেল চালাতে থাকে। শীত বাড়লে কুঁকড়ে থাকা ছেলেকে যখন গায়ের একমাত্র চাদরটা ছুড়ে দেন তখন দারিদ্রতা পেরিয়ে উঠে আসে বাবা, বা যখন ছেলের আনা ফুল শুঁকে নাসিম হেসে ওঠে তখন কিছুটা সময়ের জন্য মনে হয় এই রিফিউজি নাসিম না হয় ছেলে কে পেয়েছে, বাকি হাজার হাজার নাসিম কি করছে?
সাতদিনের নাসিমের চলার পথ কোনভাবেই সুখের না, কখনো বিরোধী পক্ষের ছড়ানো আলপিন তার সাইকেল অকেজো করে, তো কখনো গুন্ডা সর্দারের ফোনে হুমকি আসে। হঠাৎ বৃষ্টি নামলেও সে থামতে পারে না তাকে চক্রাকারে ঘুরতেই হয় একটানা।
 
 
 
 
 
 
 
 
এই চক্রাকারে ঘোরা শুধু মাত্র সাইকেল চালানো নয়, এটা জীবন বৃত্ত। যেখানে নাসিমদের মত ঘরহীন দেশহীন মানুষদের ঘুরে যেতে হয়। নাসিম কোনও কিছুতেই টলে না , মৃত্যু ভয় তাকে ছোঁয় না, কারণ সে জানে শারীরিক ভাবে সে বেঁচে থাকলেও সমাজের কাছে পরিসংখ্যান গত ভাবে সে মৃত।


তবে ধীরে ধীরে ক্লান্তি নাসিমকে গ্রাস করে। একই সাথে সাত দিনের মেয়াদ শেষ হওয়ার সময় এগিয়ে আসে । বাড়তে থাকে নাসিমের অসুবিধা । সে সাইকেল চালাতে চালাতে দেখে যে কত শত আফগান রিফিউজি কুয়ো খোঁড়ার কাজ পেয়ে চলে যায় । এ অবস্থায় নাসিমকে আক্ষেপ না করতে দেখে আমি বিস্মিত হই। কিন্তু যখন দেখি সেই শ্রমিকরা টাকার জন্য বিদ্রোহ করে তখন বুঝি নাসিম কেন আক্ষেপ করেনি।


নাসিমের নামে রূপ কথা প্রচার হতে থাকে সে নাকি ভারতে হাত দিয়ে ট্রেন থামিয়েছে , যতদিন এগোতে থাকে নাসিমের পক্ষে জুয়ার লগ্নি তত বাড়তে থাকে। তাতে নাসিমের কোনও হেলদোল বাড়ে না। কারন নাসিম জানে তাকে খুব সামান্য টাকা দেওয়া হবে। শেষের দিন এর সিনেম্যাটিক ভাবনা এবং তার প্রকাশ ভঙ্গি যেকোনো মানুষের চোখে জল এনে দেবে । যখন ঘুম আটকাতে নাসিম দুচোখের পাতাতে আলপিন আটকে সাইকেল চালাতে থাকে । তখন ওই আলপিন কি কোনভাবেই যুদ্ধবাজদের দুচোখে ফুটিয়ে দেন না পরিচালক? বা প্রায় অচেতন নাসিমের মুখে যখন তার নিজের ছেলে এক এর পর থাপ্পর মেরে তাকে জাগিয়ে রাখবার চেষ্টা করে তখন কি ওই থাপ্পর গুলো গিয়ে পড়ে না রাষ্ট্রনায়ক দের মুখে , যারা সীমানা নির্ধারণ বা শান্তির খোঁজে যুদ্ধ করে। হ্যাঁ পিন ফোটে দু চোখের রেটিনা জখম হয় , থাপ্পর সজরে পড়ে শক্তিশালী মানুষদের মুখে। আর পড়ে বলেই আজ ২৫ বছর পর বাংলার গ্রামে বসা একটা ঋত্বিক ঘটক পাগল ছেলে ইন্টারনেটে তন্ন তন্ন করে খুজে এই ছবির প্রেক্ষিত খুজে না পেয়ে পাগলের মত লিখতে শুরু করে। রিফিউজি যন্ত্রণা নিয়ে ছবির কেন কোনও সৎ ব্যাখ্যা থাকেনা? কেন? কেন আপসহীন মানুষ গুলকে নিয়ে আপোষ করে পরের দিকে কিছু ভেকধারি?


নাসিম তো আপোষ করে না জেতার আনন্দে মাতে না , তার চারিদিকে অজস্র টিভি ক্যামেরা দেখে সে উচ্ছাস প্রকাশ করে না। নাসিমের সাতদিন পূর্ণ হয়ে যায় নাসিম তাও থামেনা । আসলে সে থেমে করবে টা কি? তাকে রিফিউজি জীবনের বৃত্ত আষ্টেপৃষ্টে বেধে ফেলেছে। সে জানে এই ঘূর্ণি থেকে বেরলে অন্য কোনো ঘূর্ণি তার জন্য অপেক্ষা করছে। পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যায় এক মিলিয়ন আফগান রিফিউজি আছেন ইরানে। আর অবাক হয় না কুর্নিশ জানাই পরিচালক বাফকে। কুর্নিশ করি গার্ডেনার ছবির জন্য। কুর্নিশ করি আমাকে সাহস দেওয়ার জন্য।



ছবিঃদ্য সাইকেলিস্ট

পরিচালকঃ মহাসিন মাখমাল বাফ।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন