এক ঝাঁক
ইচ্ছেরা কড় গুনে গুনে স্বপ্ন দেখে। ভবিষ্যতের রংমশাল নিজেরাই মনের মধ্যে জ্বালায়।
কখনও সেই রঙিন আলো নিভে গেলে ম্যাজিশিয়ানের আবির্ভাব হয়, আর তার রুপোকাঠির ছোঁয়ায়
রাস্তারা আবার আস্তানা খুঁজে পায়।
ঠিক
এইভাবেই স্বপ্ন দেখত রুবায়েত। তার ইশারায় জীবন চলবে, তিন কাঠির বেড়াজালে বল গিয়ে
আছড়ে পড়বে বারবার। আর এই ভাবেই বহুদিন আগে স্বপ্ন দেখত মতিদা। দুটো স্বপ্ন এক,
দুটো ইচ্ছে এক, শুধু সময়টা আলাদা, আলাদা প্রেক্ষিত, তাই ইচ্ছেপূরনের গল্পটা আর এক
থাকে না, সময়ের সাথে সাথে সেটাও বদলে যায়, আর বদলে যায় বলেই দুটো স্বপ্ন এক হয়ে
যায়, দুটো ইচ্ছে এক হয়ে যায়, দুটো মন এক হয়ে যায়, ফারাক শুধু একটাই একটা মনে আর
একটা মনের প্রবেশ ঘটে। বহুবছর আগে হারিয়ে যাওয়া ইচ্ছেরা, মানুষটা আবার খুঁজে পায় এই
তরুণ উচ্ছ্ব্ল বালকটির মধ্যে। স্বাধীন ভাবে তাই স্বপ্নরা বেঁচে থাকে, স্বাধীন ভাবে
তাই পোশাক পড়ে নেমে পড়তে হয় ময়দানে, সবুজ ঘাসগুলো সাদরে আহ্বান জানায়। “বাই সাইকেল
কিক”, দেবাশিস সেনশর্মা ও সুমিত দাস পরিচালিত নতুন বাংলা ছবি ঠিক এই স্বপ্নের
গল্প, এই ইচ্ছের গল্প।
সত্যিই
তো যদি ইচ্ছেডানায় ভর করে পক্ষীরাজ তাহলে তো ডানা মেলে উড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। তাই
তো রুবায়েত এর জোরালো শট তিনকাঠি পেরিয়ে বেড়াজালে বন্দি হয়, আর তখনই পায়রাগুলো
আবার ঘরে ফেরার তাগিদে সবাই একসঙ্গে উড়ে যায়, উড়ে যায় মন, উড়ে যায় ভালবাসা, উড়ে
যায় বহুদিনের জমে থাকা ইচ্ছেরা।
বাংলা
সিনেমা তার বেডরুম থেকে বেরিয়ে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। কখনও উত্তর কলকাতার অলিতে
গলিতে বা কখনও কোন গ্রামবাংলার লালমাটিতে ঘুরে বেরায়। দৃষ্টিকোণে জমা হতে থাকে
আমার শহর, আমার বাংলার পুঞ্জিভূত স্রোত। স্বাধীন চিত্রপরিচালকদের কাছে সমস্যা ঠিক
এইখানেই, সীমিত বাজেটে ছবি বানানো। যেখানে অনেক ইচ্ছে অধরাই থেকে যায়। কিন্তু এই
সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও কিভাবে গল্প পরিবেশক দর্শক মনে উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করে, বাই
সাইকেল কিক তার উদাহরণ।
শুধুমাত্র
ঝাঁ চকচকে লোকেশন, আর দামি অভিনেতা অভিনেত্রী ছাড়াও যে, গল্পের জোড়ে, সংলাপের
জোড়ে, দৃশ্যগ্রহণের জোড়ে, সম্পাদনার জোড়ে সর্বোপরি পরিচালনার জোড়ে ছবির অধিকাংশ
তাত্ত্বিকতাকে মেনে, ছবিকে সম্পুর্ন আলাদা একটা মাধ্যম হিসাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার
ইঙ্গিত, ও তদপরি নিজের প্রয়াসের ছাপ রেখে যাওয়ার ব্যবহার বাংলা ছবিতে নতুন একটা
দিগন্তের উন্মোচন করে। যেখানে থিওরি আর টেকনিক মিলে যায়।
কবিতা
কখনও ছবির ভাষা হতে পারে, কবিতার তো স্বকীয়তা আছে, তবু কেন সে ছবির ভাষা হবে, ছবির
তো নিজস্ব ভাষাই আছে, যা নিয়ে সেই প্রাচীন যুগ থেকে তর্ক চলেই আসছে। কিন্তু একটা
ছবিতে যদি কোন দৃশ্যকাব্য রচনা হয়, যদি আমি সংলাপের বদলে কবিতা দিয়ে প্রেমের ছবি
আঁকি তাহলে? তাহলে আমি একটা ছবির মধ্যে দিয়ে একটা কবিতা বলতে পারি। দুটো মাধ্যম
সম্পুর্ন আলাদা হয়েও মিশে যেতে পারে একে ওপরের সাথে। তাই তো ছবির মধ্যগগনে
ক্যামেরা যখন প্রবেশ করে শহরের আনাচ-কানাচ থেকে সবুজ বাংলার এবড়োখেবড়ো মেঠো পথে,
তখন তার রূপ কবিতা হয়ে ঝড়ে পড়ে পর্দার ওপরে।
বাস্তব
জীবনে রুপকথার পরি আসে, তার কানেকানেও জোনাকি গুনগুন করে, ভালবাসা ফুচকার জল
পেরিয়ে পারি দেয় জীবন দেখানোর ছন্দে। যেখানে রাজকন্যা এলচুলে মাতোয়ারা হলে সন্ধ্যে
ঘনিয়ে বৃষ্টি নামে। শহরের বুক থেকে চুইয়ে চুইয়ে পড়ে ভালোবাসার গন্ধ মাখা জল। আর
মাধবীলতা যখন অতুলপ্রসাদের সুর তোলে তখন ঘরময় এক নিস্তব্ধতা প্রবেশ করে যা চেনা
মুখগুলোকে খানিক্ষনের জন্যেও ভাবের জগতে প্রবেশ করায়।
নতুন
ভাবে নতুন আঙ্গিকের কথা যদি বলতেই হয় তা হল এই ছবির দৃশ্য, প্রচণ্ড রঙিন অবায়ব,
চারপাশের পরিবেশও যেন রঙ মেখে অপেক্ষা করছে ফ্রেমে উপস্থিত চরিত্রদের সাথে। ছবির
দৃশ্যের সাথে সাথে ছবির সম্পাদনাও নতুন মাত্রা যোগ করে। একটা দৃশ্যের পর অপর একটা
দৃশ্য ব্যবহার ও সেই সাথে ক্যামেরার ব্যবহার, তার স্থানবদলের প্রয়োগ রীতি যেন প্রতিটা ফ্রেমকে দৃশ্যবহুল ও
অর্থবহ করে তুলেছে। এছাড়াও ছবিতে ব্যবহৃত স্থায়ী ও অস্থায়ী উপাদান যা এক একটা
ফ্রেমের অর্থকে আরও গাড় করে প্রকাশ করে। এর প্রমান মেলে খুব ভালভাবে রাশিয়ান
পুতুলের ব্যবহারিকতায়। মনের মধ্যে মন, অন্যমন, অন্যমনস্কতার সিম্বোলিক পরিচয়।
ছবির
চরিত্র চিত্রণের ক্ষেত্রে প্রথমেই নজর কাড়ে, টেনিদা ও তার পালের ব্যবহার। যারা আজও
ওই উত্তর কলকাতার রক গুলোকে জমিয়ে রাখে, আর কেউ বিপদে পড়লেই চিৎকার করে বলে ওঠে,
ডি লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফেলিস......... ইয়াক...ইয়াক। এছাড়া আর যার কথা না বললে
লেখাটাই অধরা থেকে যায় সে হল মতিদার চরিত্রে অভিনয় করা ঋত্বিক। তার কেরিয়ারে নবতম
সংযোজন এই চরিত্র। যা এককথায় অনবদ্য। তাই বাধ্য হয়েই মনে থেকে যায় পর্দায় তার
উপস্থিতি, ইচ্ছের সাথে এগিয়ে চলার ইচ্ছেপ্রসন।
পরিশেষে
বলতেই হয় ছবির সঙ্গীত ও আবহসঙ্গীতের কথা। গানের কথা আর দৃশ্যের পিছনে ব্যবহৃত
আবহসঙ্গীত ছবিকে অন্যমাত্রায় নিয়ে যায়, তাই পরতে পরতে যখন এক একটা দৃশ্যের পিছনে
শব্দের বা সঙ্গীতের ব্যবহারিক প্রয়োগ ঘটে তখন সেই দৃশ্যের মাহাত্ম্য অনেকটা গূঢ়
হয়, চোখের সাথে সাথে কানেও উপলব্ধ হয়। তাই চোখ বুজেও মাঝে মাঝে সেই সুগন্ধটা পাওয়া
যায়।
বাইসাইকেল
কিক এক নবতম উদ্যোগ বাংলা ছবির জগতে, এক ইচ্ছেপ্রসনের স্বাধীনতা, মাধবীলতা, আর
রুবায়েতের গল্প, মতিদার স্বপ্নপূরণের হাতছানি, সিধু জ্যাঠার দাবার চাল, পটলডাঙার
অস্তিত্ব, ফুটবল থেকে বল গরিয়ে গোল আর ম্যাজিশিয়ানের রূপোকাঠির ছোঁয়ায় বাস্তবতা আর
রূপকথার মেলবন্ধন, এসবের সংকলন।
(সম্পাদনাঃ অনুসুয়া চন্দ্র)
ছবিঃ
বাইসাইকেল কিক
অভিনয়ঃ
সৌরভ, রিধিমা, ঋত্বিক, সৌমিত্র চ্যাটার্জি প্রমুখ।
সঙ্গীতঃ
জয় সরকার।
আবহসঙ্গীতঃ
মৈনাক বাম্পি নাগ চৌধুরী।
পরিচালনাঃ
দেবাশিস সেনশর্মা ও সুমিত দাস।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন