বুধবার, ১২ মার্চ, ২০১৪

হাইওয়ে


 তোমার চারপাশ ঘিরে এত নিয়মের বেড়াজাল এত জৌলুসের দূষণ সেখানে আর সুস্থ সম্পর্কের সবুজ কচি পাতার জন্ম হয় না। অক্সিজেনের বড্ড অভাব । উপহারের বনসাইটাও নিশ্চয় এতদিনে অভিযোজিত হয়ে ফণীমনসা হয়ে গেছে।  এর থেকে ঢের ভাল একটা অপহরন একটা মুক্তি। জীবনের জন্য সিস্টেম থেকে বের হয়ে হাইওয়ে বেয়ে নতুন প্রান খুঁজে নেওয়া।  ভাল আর খারাপের মধ্যের ফারাকটা কি সুধু মাত্র দেখনদারিতে নাকি আরও গভীরে এর শেকড়? অনেক প্রশ্নের একটা উত্তর ইমতিয়াজ আলি’র “হাইওয়ে” ।

 বিয়ের রাতে “ ভীরা” (আলিয়া ভাট) কে একদল ডাকাত অপহরন করে। একটা ট্রাকে পুরো দলটা সারা রাত জুড়ে বিভিন্ন অজানা গন্তব্যে ঘুরতে থাকে । ভীরা মুক্তির জন্য ছটপট করতে থাকে। নৃশংস ভাবে তাকে বেধে রাখা হয়, মুখের মধ্যে গুঁজে দেওয়া হয় কাপড়ের টুকরো যাতে সে চেঁচামেচি না করতে পারে। এরপর এক সময় তার হাতের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়। সে পালিয়ে যেতে চায়, ছুটে যায় ঘন দিকশূন্য অন্ধকারে কিন্তু ঠিক পরমুহুর্তেই সে ফিরে আসে। এখান থেকেই “হায়ওয়ে” রাস্তার ইমেজের সাথে জীবনের পাওয়া না পাওয়ার গল্প বলতে থাকে। দুটো পরস্পর বিরোধী পরিবেশে বেড়ে ওঠা মানুষ । একজন শিল্পপতির মেয়ে আর একজন না খেতে পাওয়া ঘর থেকে উঠে আসা কিডন্যাপার মহাবীর ভাটি ( রনদীপ হুডা) ।

 

 এখানে ছবির সফর চলে সম্বর ,আজমের , বিকানির, ফারিদকোট  এই শহর গুলোর অসাধারণ ল্যান্ডস্কেপে। দুজন অচেনা মানুষের কিছু আত্মকথা আমাদের কে কিছু সত্যের মুখোমুখি দাড় করিয়ে রাখে। ধীরে ধীরে আমরাও কেমন যেন লজ্জিত হয়ে আত্মসমর্পণ করি এই দুটি মানুষের কাছে। বুঝতে পারি কেন এই সুশিক্ষিত মেয়েটি কিছুতেই বাড়ি ফিরতে চায়নাকেন সে তার জৌলুস মোড়া জীবনকে ঘেন্না করে। একে একে সে তথাকথিত বস্তুবাদী অন্তরসারশূন্য অগুনতি পরিবারের মেয়েদের মুখ হয়ে ওঠে । সে এক রাতে প্রকাশ করে ফেলে যে কিভাবে শৈশব থেকে বার বার অভিভাবকের কাছে যৌন নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করতে হয়েছে। কিভাবে রূপকথার আড়ালে চুরি হয়ে গেছে মেয়েবেলা।

 ট্রাক থেমে থাকে না।  ল্যান্ডস্কেপ কাজা, পেহেল্গাও, আরহ ঘুরে সুন্দর থেকে আর সুন্দর হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের অস্বস্তি কমে না , আসলে কমবে বা কিভাবে পর্দা থেকে শ্লেষের থুতু গুলোতে আমাদের সারা শরীরে পড়তে থাকে। যেখানে এক ছেলে যে নিজে কিডন্যাপার কিন্তু সেতো প্রতিমুহুর্তে ফ্ল্যাশব্যাকে দেখতে পায় “মা কে নিয়ে একটা ছোট্ট চাষি ঘর, দু মুঠো খাবার আর মায়ের সম্মান” এতুটুকু তাকে আমাদের এই সিস্টেম দিতে পারেনি। তাহলে পারলোটা কি? সমাজের দুটি প্রান্তসীমা এত নিরাপত্তা হীনতাতে ভুগছে? আলোর রোশনায় ভর্তি ঘরেও একটি কিশোরী দিনের পর দিন অত্যাচারিত , অন্ধকারের নীচে থাকা একটা কিশোর দুমুঠো ভাতের জন্য শৈশব বিসর্জন দিয়ে হাতে তুলে নেয় অস্ত্র। জীবনের “হাইওয়ে” বড্ড কঠিন , বড্ড প্যাঁচালো এখান থেকে মুক্তি পাওয়া অত সহজ নয়।
 আশ্চর্যময়ী বিশ্বাস করো সিনেমা থেকে বেরিয়ে ইমতিয়াজ কখন যেন ছুয়ে যায় তোমাকে। যতবার “ভীরা” গাছকে, পাথরকে, ঝর্ণাকে, আকাশাকে, জড়িয়ে ধরে ততবার তুমি প্রাণ ভরে অক্সিজেন নিতে পার। এই যে একলা থাকা তুমি রাস্তা ঘাটে চলাফেরার সময় তোমার দশদিক থেকে হিংস্র কুকুরের মত দৃষ্টিতে তাকানো মানুষদের থেকে দূরে যেতে চাও তা জানি, কিন্তু যেতে পার কি? সিনেমা হয়ত একারনেই সিনেমা সব না পারাদের পারা নিয়ে কথা বলে।

 হাইওয়ে ছবির এই দুই স্তরের ভাবনার পাশাপাশি এ আর রহমান এক নিশ্চিন্ত যাপনে চলাফেরা করিয়েছেন আমাদের মননকে , কখন ঘুম পাড়ানি লোকগান বা শুধুমাত্র সবুজ পাহাড়ি উপত্যকা জুড়ে পশুপালকদের মুখে ঘোড়া শব্দ জুড়ে সুর তৈরি করে। কিন্তু সব সফর শেষেও তথাকথিত প্রেম বলতে যেটা আমরা বুঝি সেটা বাদেও কিছু একটা তৈরি হয় ছবির  দুই প্রটাগনিস্টের মধ্যে , যে সম্পর্ক বোঝার চেষ্টা সভ্য সমাজ করে না । বরং রাষ্ট্র বন্দুক হাতে নেমে পড়ে তার দেশের একজন বেয়াড়া নাগরিককে শিক্ষা দিতে। গুলিতে ঝাঁজরা হয় স্বীকৃতিহীন আস্থা, এতদিনের ভরসার খোঁজ নিতে গেলে ঘুমপাড়ানি ইনেজক্সন জোটে । এভাবেই ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ে একটা সমাজ। সব কিছু পেরিয়ে দু একটা ভীরা অস্ফুটে বলে ওঠে “ আমার সমুদ্র দেখার খুব ইচ্ছে, জানিনা পূরণ হবে কিনা, ছেলে হলে ভাল হত অন্তত ঘরের বাইরেটা দেখতে পারতাম, জানতে পারতাম সিস্টেমের বাইরে মানুষ কিভাবে বাঁচে?” কিন্তু এদের জন্য একটাও হায়ওয়ে  নেই, একটাও কিডন্যাপার নেই, শুধুমাত্র একটা দমকা বাতাস বার্তা বয়ে আনে “ এই নাও মুঠো ভরে অক্সিজেন ছড়িয়ে দিলাম, দম দেওয়া পুতুল এবারতো শ্বাস নাও” ।  
আর যে দু একজন জেদি মানুষ ঘুমোয় না তারা প্রশ্ন করে, উত্তর না পেয়ে একা একা বাঁচতে শুরু করে সব সামাজিক ভাল মন্দের বাইরে গিয়ে।

ছবি- হাইওয়ে

অভিনয়ে- রনদীপ হুডা, আলিয়া ভাট প্রমুখ।

সঙ্গীত- এ.আর. রহমান

পরিচালনায়- ইমতিয়াজ আলি।                       

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন