উঁচু পাহাড়ের গা ঘেঁষে হেলিকপ্টারে ক্যামেরা নামে আফ্রিকাতে জঙ্গল পাহাড় নদী পেরিয়ে আরও গভীরে ক্যামেরা খুজে পায় শঙ্করের প্ল্যাটফর্ম , জনমানব শূন্য এলাকা চারিদিকে শুকনো ঘাস। এই তো সেই উঁচু শুকনো ঘাসের আফ্রিকা তার মাঝে আমাদের বাংলার ছেলে শঙ্কর পেছনে মানুষ খেকো সিংহ। শঙ্কর কি করবে? হত্যা করবে? পালিয়ে আসবে? না না সিনেমার শঙ্কর এত কিছু ভাবে না । তাঁকে বুনো হাতির আগে দৌড়তে হয় , একটা লাফ দিয়ে ইউটার্ন নিয়ে গুলি করতে হয় না হলে যে ১৫ কোটির চাঁদের পাহাড়ের “হিরো শঙ্করের” চরিত্রের গঠন সম্পূর্ণ হয় না।
উপন্যাস থেকে ছবি করার ক্ষেত্রে
এই গল্পবলার পদ্ধুতিগত দ্বন্দ্ব চিরকালীন । কিন্তু সিনেমার শঙ্করের ক্ষেত্রে
একটু বেশী অগোছালো। সারা চাঁদের পাহাড় ছবি
জুড়ে এই লড়াই চলে। কিছুটা সময় শঙ্কর নিজে গল্পটা বলে কিছুটা সময় তৃতীয় গল্পকার,
সেখানেই মূল দ্বন্দ্ব। শঙ্কর প্রথমে হাতির সাথে লড়াই করে , দক্ষিণ ভারতীয় বন্ধু
তিরুমলকে মেরে ফেলা মানুষ খেকো সিংহকে হত্যা করতে আফ্রিকান মাসাইদের মত নিজের সারা
শরীরে রক্ত ঢেলে মাংস ছড়িয়ে যে পরিবেশ ছবিতে সংগঠিত হয় সেটা তো শঙ্কর নয় সেটা
ভারতীয় বানিজ্যিক ছবির হিরো। এটা তো বহুদিনের ছক সেই শোলে থেকে দেবের রংবাজ পর্যন্ত
এই সফর জুড়ে এই হিরোর দাপাদাপি ।
কিন্তু চাঁদের পাহাড়ে শঙ্করের চরিত্র ধীরে ধীরে দৃঢ় হয়, সুরুতে সে একজন পরিব্রাজক তার পর অ্যাল্ভারেজের সঙ্গী শঙ্করকে আফ্রিকার জঙ্গলের জীবন একজন দৃঢ় যোদ্ধাতে পরিণত করে । জীবন তাঁকে শেখায় একটা সময় যে শঙ্করের পেছন পেছন সিংহ তার ষ্টেশনের ঘর পর্যন্ত চলে আসে , যে শঙ্কর প্রায় সারারাত সিংহের সাথে লুকোচুরি খেলে বেঁচে থাকে সেই শঙ্কর তো আবার বুনিপ নামক একটা বিরাট জন্তুকে হত্যা করে। কাজেই ছবিটা প্রচণ্ড খারাপ এটা ঠিক নয় অসুবিধাটা আসলে সম্পাদনার ক্ষেত্রে বড্ড ব্যস্ততা ছবিটাকে ঘেঁটে দিয়েছে, যে কারনে ছবি দেখতে বসলে বার বার জার্ক লাগে। দেব ছবিটা জুড়ে ভীষণ খারাপ বাংলা বলেন কিন্তু বাংলা ছবিতে ১৫ কোটির লগ্নি যে দেব ছাড়া করা এক কথায় অসম্ভব । যে প্রজন্মটা চাঁদের পাহাড় বই টা পড়েনি তারা তো কিছু একটা আকর্ষণে ছবিটা দেখতে আসবে? মুল কথা বানিজ্য । কিন্তু একথাও তো সত্যি হাতে সব উপাদান থাকা সত্তেও শুধু বানিজ্যের দিকে তাকিয়ে একটা ননলাইনার জার্ক ভর্তি ছবি বানাতে হবে?
আমি ব্যাক্তিগত ভাবে এই নীতিতে
বিশ্বাস করিনা , যেমন আমার ওই আগ্নেয়গিরির দৃশ্য বা বুনিপের অ্যানিমেশন প্রচণ্ড
গোঁজামিল লেগেছে। আবার অ্যাল্ভারেজের সাথে শঙ্করের জার্নির প্রথম অংশ ভালো লেগেছে।
তবে একথা ঠিক যদি একজন মাত্র নির্দিষ্ট গল্পকারের জবানিতে ছবিটা বলা হত তাতে
দৃশ্যগুলো আরও শক্তিশালী হত। এবং বারে বারে গল্পের ডায়মেনসন বদলাতে গিয়ে ছবির
শরীরে অবাঞ্জিত মেদ বাড়তে থাকে । যে কারনে ছবিকে বিরতির পর ভুগতে হয় চমকের অভাবে
কিন্তু এখানেই তো চাঁদের পাহাড় ছাপিয়ে যেতে পারত সমকালিন সব ছবিকে। অ্যাল্ভারেজ
বার বার পথ হারাচ্ছেন, ডেথ ট্র্যাপে পড়ছেন , আগ্নেয়গিরির সামনে পৌঁছে যাচ্ছেন ,
খাবার ও জল ফুরিয়ে যাচ্ছে। গুরু মারা গেলেন শিস্য একা হয়ে গেল এই জঙ্গলে। যে নিজে সেক্সট্যান্ট যন্ত্রের ব্যবহার জানে না , সে
তারা দেখে দিক নির্ণয় করতে পারে না। যে হীরের খোঁজে জীবন বাজি রেখে এতটা পথ সে
পেরিয়ে এসেছে সেই হীরের খনিতে শঙ্কর । এটা হতে পারত ছবির সব থেকে প্রভাবশালী দৃশ্য
যে জীবন কত কঠিন, আজ শঙ্করের চারিদিকে হীরে আর হীরে সে হীরে চিনতে পারে না শুধু
বেঁচে থাকার তাগিদে। ডেথ ট্র্যাপ ভেঙে বেরোনোর জন্য সে হীরে দিয়ে দিক চিহ্ন তৈরি
করে। এখানে তো স্পেস ডিভিশন হতে পারত যেমন “মিরর”
ছবিতে হয়েছিলো। নিশ্চিন্তে পরিচালক কমলেশ্বরবাবু জীবনের সবথেকে বড় সত্য কে
ধরতে পারতেন “যে হীরের জন্য জীবন বাজি রেখে এতটা পথ চলা , বেঁচে থাকার তাগিদে সেই
হীরে বিসর্জন দিয়ে জীবনকে খোঁজা একটু জল আর একটু খাবার তাগিদে”। এই অংশটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভাবে ধরা যেত
পর্দাতে। শঙ্করের চরিত্রের গঠন সম্পূর্ণ হতে পারত এই ক্রাইসিসে । চাঁদের পাহাড়ের আসল সত্য সফর , এবং অবস্থার সাথে সাথে
শঙ্করের চরিত্রের পরিবর্তন এটুকু বাদে আর সব আছে কমলেশ্বর বাবুর এই ছবিতে । শৌমীক
হালদারের অতন্ত শক্তিশালী ক্যামেরা আফ্রিকাকে ধরে, জুলু নাচ কে ধরে, বাঘ, সিংহ , ব্লাক মাম্বা সহ একটা গোটা জীবন্ত সফরকে
ধরেন শুধু বিভূতিভূষণের ভয়ঙ্কর অথচ সুন্দর , শান্তির অথচ হিংস্রতার নিঃশ্বাস কে
ধরতে পারেন না চিত্রনাট্যের দুর্বলতার জন্য।
কিন্তু এত কিছুর পর ও তো ছবিটা চলে, নতুন প্রজন্ম ভিড় করে । তারা জানতে পারে শঙ্কর নামক এক সাহসী বাঙালি যুবকের কথা। বাংলা পাঠ্য বই থেকে শঙ্কর বিদায় নিয়েছে অনেকদিন। এখন সুধু আগ্নেয়গিরির অংশটা কিছু ছেলে মেয়ে পরীক্ষার জন্য পড়ে “সূর্যের নাভির মত” শিরোনামে। এরাও একদিন জানবে সেই ধুতি পাঞ্জাবি পরা মানুষটির কথা। যার উপন্যাসের ভিত্তিতে বিলেত ফেরত এক যুবক অনেক অর্থকষ্ট পেরিয়ে সরকারি অনুদান নিয়ে প্রায় চার বছর ধরে ধুকে ধুকে “পথের পাঁচালী” বানিয়েছিলেন। না সেখানে রিলিজ ডেটের তাড়া ছিল না। পাবলিসিটির প্রচণ্ড ধান্দা ছিল না। তবে নায়ক নায়িকা বর্জিত ছবিতে আশঙ্কা ছিল “চার বছরে অপুর ( অভিনেতা সুবীর ব্যানার্জী) বিরাট কোনও শারীরিক পরিবর্তন হয় কিনা, কিন্তু তা হয়নি, হলে হয়ত আর ছবিটা করা হতনা” । এখানেই সময় কথা বলে দামি বাজেটের মার্কেট না চিরকালীন পারফেকশন ? এসব কোনও কিছুই যদিও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কে কোনোদিন ছুঁতে পারেনি। ছোঁবেও বা কি ভাবে? তার সময়ের বাজার তার মুল্য হয়ত বোঝেনি তাই অবহেলা জুটেছে। এদিকে আজ এত বছর পর শ্বাসকষ্টে ধুঁকতে থাকা বাংলা বইশিল্প , যেখানে বড় পাবলিকেশন হাউস বইবাজার বিশ্লেষণ করে “খাচ্ছে” বলে একের পর এক রাবিশ পাঠের অযোগ্য বই প্রকাশ করে যাচ্ছে। একটার বদলে সমগ্র প্রকাশে আগ্রহী হচ্ছেন সেখানে এখনো একা একা পাল্লা দিয়ে বিকচ্ছে “চাঁদের পাহাড়”,“আরণ্যক” ।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর
চাঁদের পাহাড়ের সেই হীরক খনি যেখানে গড়া গড়ি যায় অসংখ্য হীরের টুকরো সেখান থেকে দু
একটা হিরে অপচয় হয় ছবি করতে গিয়ে, পড়ে থাকে আরও অনেক। আজ বাংলা ছবির সুখের দিন কিন্তু কঠিন সময়ে হয়ত
আবার এই খনি থেকে অন্য একটা হীরে নিয়ে ছবি হবে , যেখানে বাজেটের চাপ থাকবে না,
মার্কেটের লাল চোখ থাকবে না। বরং এক মুঠো
অক্সিজেন থাকবে , যে অক্সিজেন প্রতিরাতে
ফিল্মস্টাডিজের এক নাম না জানা ছাত্রের বালিশের পাশে রাখা আপনার
অ্যাল্ভারেজ, দব্রুপান্না , অপু , দুর্গার থেকে বাহিত হবে স্বপ্ন থেকে স্বপ্নে ।
আপসহীন ছবি করার স্বপ্নে।
কৃতজ্ঞতা ঃ আদিত্য।
ছবিঃ চাঁদের পাহাড়
মূলকাহিনীঃ বিভূতিভূষণ
বন্দ্যোপাধ্যায়
পরিচালনাঃ কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় কৃতজ্ঞতা ঃ আদিত্য।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন