মঙ্গলবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১২

চিটাগাং-- অজানা এক ইতিহাসের গল্প






  শরতের হিমেল পরশ যখন সবার গায়ে তার শীতল স্পর্শ রেখে আগমনীর ধ্বনিতে মুখরিত করে তুলেছে, নতুন পোশাকের লোভে সবাই যখন দোকানের সামনে লাইন দিয়েছে এমনই এক সোনালি রৌদ্র মুখরিত দিনে সকাল বেলা শ্মশান থেকে এসে আবার দৌড়ে ছুটলাম ছবি দেখতে। বেদব্রত পাইন পরিচালিত “চিটাগাং”।
ও হ্যাঁ এর আগের কথাটা বলি আগেরদিন সকালে শুভঙ্কর যখন বলল আগামিকাল ছবিটা দেখতে যাবে, শুনেই আমার মুখের বাঁদিকে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। আমিও বেশ কিছুটা মুহূর্ত ইতিহাসের সাক্ষী হবার লোভে, ইতিহাসকে আরও বিশদ ভাবে জানতে প্রথমে ছুটলাম ছোট ভাইয়ের কাছে, ওর ইতিহাস বইয়ের পাতায়  একবার আবার ঘটনার বিবরন পড়বার আশায়। পাতার পর পাতা উল্টোলাম কিন্তু মাত্র ২ টো লাইনের বেশি খুঁজে পেলাম না। যদিও খুব বেশি পাতা উল্টোতে হয় নি কারন পাতা উল্টানো শুরু হতেই না হতেই তা শেষ হয়ে যায়। আমদের ছোটবেলায় আমরা যে বৃহৎ আকারের ইতিহাস বই পড়েছিলাম তাতেই মাত্র কয়েকটা অনুচ্ছেদ ছিল আর এখন তো খাতার থেকেও পাতলা বইতে এর থেকে আমি বেশি কি আশা করতে পারি। সব কিছুতেই পরিবর্তন শিক্ষা থেকে কৃষি, কৃষি থেকে বাণিজ্য, বাণিজ্য থেকে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সব কিছুতেই এক চরম বাহ্যিকরনের তীব্র প্রয়াস।
আমি এতক্ষন ইতিহাসের যে পাতাটার কচকচানি করছিলাম তা হল ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ও মাস্টারদা সূর্য সেন। কিভাবে মাস্টারদা তার কয়েকজন  সহচর তথা বিপ্লবী নির্মল, গণেশ, অনন্ত প্রীতিলতাদের নিয়ে ও প্রায় ৬০ এর কিছু বেশী তার কিশোর ছাত্রছাত্রী দের নিয়ে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি নামে যে দল গঠন করেছিলেন ও চট্টগ্রামকে একদিনের জন্য স্বাধীনতার ছোঁয়া দিয়েছিলেন, শেষে যুদ্ধে ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হয়ে নিজে ফাঁসির মালায় নিজেকে সমর্পিত করেছিলেন। এই ইতিহাসই আমদের পাঠ্য বইতে ছিল এর বেশী কিছু না এর বেশী আশা করাটাও বোধহয় বৃথা। যে বইতে বাঘাযতিন সম্পর্কে শুধু নাম ছাড়া আর বেশী কিছু পাওয়া যায় না সেই বইতে মাস্টারদার সম্পর্কে এত কিছু লেখা হয়েছে এ মাস্টারদা চরম সৌভাগ্য।
তাই এক বুক হতাশা নিয়েই ছবিটা দেখতে গেলাম। কিন্তু এক পরম আনন্দ আমায়  অভিভূত করল যখন এক অন্য ইতিহাস আমি জানতে পারলাম। এক কিশোরের চোখ দিয়ে আমি যখন মাস্টারদাকে দেখতে পেলাম। এখানে মাস্টারদার ইতিহাস ছবির গল্প নয়। এখানে মাস্টারদা কিভাবে একজন কিশোরকে প্রভাবিত করেছিল যে সে তার বিদেশ যাত্রা ত্যাগ করে দিয়ে মাস্টারদার দলে যোগদান করেছিল ও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছিল। বেদব্রত পাইন পরিচালিত ও প্রযোজিত “চিটাগাং” এক কিশোরের গল্প, তার লড়াইয়ের গল্প, তার অনুপ্রেরিত হওয়ার গল্প। “চিটাগাং” আসলে সুবোধ ঘোষের গল্প, ঝুঙ্কুর গল্প।
যে মাস্টারদা এতদিন আমাদের কাছে তার নিজ আঙ্গিক দিয়ে শ্রেষ্ট ছিলেন এবার তার শ্রেষ্টত্ত একজন কিশোরের চোখ দিয়ে দেখান হল, যেখানে কখন ছবি জুড়ে তিনি প্রাধান্য বিস্তার করে থাকেন না। তার লড়াইয়ের দৃশ্যও বড় মৃদু। ছবি জুড়ে শুধুই ঝুঙ্কুর চোখ ঘুরে গেছে এদিক থেকে সেদিক, আর সে দৃষ্টি সর্বদাই মাস্টারদাকে কখন সামনে থেকে আবার কখন পিছন থেকে জড়িয়ে রেখেছে।
মাস্টারদার লড়াই কৌশল তাই এখানে প্রধান বিষয় নয়। তাই চরিত্রচিত্রায়নে মাস্টারদা যথাযথই। গল্পটা আমরা যার গলায় শুনি যার চোখে দেখি সেই ঝুঙ্কুই এখানে প্রধান চরিত্র। তাই যখন একজন বিপ্লবীকে ব্রিটিশদের হাতে খুন হতে দেওয়ার ঘটনায় সবাই যখন ঝুঙ্কুকে দোষী বলে বিবেচিত করে মাস্টারদা তার শিষ্যের হাত ধরে ঘোষণা করে তিনি জানেন এ কাজ সে করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে আমরা আদও জানতে পারি না যে সে ব্রিটিশদের সেই বিপ্লবীর কথা বলে দিয়েছে কিনা কিন্তু মাস্টারদার আশ্বাসবাণী আমাদের মনকে আশান্বিত করে। বোধহয় মাস্টারদার যে চিত্র আমাদের মনে অঙ্কিত ছিল সেটাই আমাদের বুঝতে আরও সুবিধা করে দেয়।
নাসার চাকরি ছেড়ে প্রথমবার ছবি করতে আসা নবীন পরিচালক বেদব্রত পাইন তার প্রথম ছবিতেই অনেক কম বাজেটে যা ফুটিয়ে তুলেছেন এককথায় অনবদ্য না হলেও যথেষ্ট ভাল। তবে ৩৬ বার চিত্রনাট্য বদলের পর চিত্রনাট্যে বেশ কিছু ফাঁকফোকর ধরা পড়ে। আমরা ছবির শুরুর দিকে বুঝতে পারি না মাস্টারদা কে? হ্যাঁ যারা ইতিহাস জানেন তারা তো নিশ্চয় জানবেন কিন্তু যারা পাশের সিটে বসা প্রেমিকযুগলের অন্তরঙ্গ মুহূর্তকে লকলকে জিভ বের করে দেখতে যায় তাদের জন্য অন্তত পারতেন মাস্টারদাকে এস্টাব্লিস করতে। তাহলে হয়ত কোনার সিটে বসা
প্রেমিকযুগলের বেরোবার সময় এত মুখ লুকিয়ে বেরোনোর প্রয়োজন পড়ত না। আরও একটা বিষয় যেটা আমারও বুঝতে একটু অসুবিধা হয়েছে,কারন কি বলুন তো একটা  ইতিহাসের সাক্ষী হতে গিয়ে আমিও খুব বেশি কিছু জেনে যেতে পারিনি। তাই ঝুঙ্কুর সাথে মাস্টারদার সম্পর্ক ও তার ওপর মাস্টারদার অগাধ বিশ্বাসের কারন আমি বুঝতে পারি না। আমি শুনতে চাই মাস্টারদার সেই উদ্দীপ্ত করা কথা যা শুনে সদ্য কৈশোর পেরনো ছেলেরাও তার দলে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু সারা ছবি জুড়ে আমি সেই কথা কে বড় মিস করি। আমার আর উদ্দিপনা আসে না শুধু ওদের হেরে যাওয়া দেখে দুচোখ বেয়ে জল পড়ে। আমি ওদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে পারি না মুখ বুজে থাকি জানি কোনদিনও পারব না।
আরও একটা বিষয় খুব চাক্ষিক ব্যাথার সৃষ্টি করে তা হল হঠাৎ করে এসে পড়া দৃশ্য।  জাম্পকাট ব্যাবহারের সময় আর একটু সক্রিয় থাকার বোধহয় প্রয়োজন ছিল, তা হলে এই হঠাৎ করে এসে পড়া দৃশ্য গুলির মধ্যে একটা সরলরৈখিক মিল খুঁজে পাওয়া যেত।
ছবি জুড়ে যে সঙ্গীত পরিবেশিত হয় তা ছবিকে এক আলাদা মাত্রায় উপস্থাপিত করে। শঙ্কর- এহেসান- লয় এর সুরে বোলো না গানটি ছবির চরিত্রদের অনেক না বলা কথাকে আমাদের সামনে আমাদের মনে শব্দের আকার দিয়ে দেয়। প্রসুন যোশির কথা নির্মল আর প্রীতিলতার ভালবাসাকে, তাদের মিলনের বিরহকে কোথাও ধুয়ে মুছে রেখে শুধুমাত্র বারবার আবেদন করে একে অপরকে তাদের একে অপরের প্রতি ভালবাসা নিবেদনের জন্য। অবাক করে আমায় কেউ চাইলেও তার ভালবাসাকে নিবেদন করতে পারে না আবার কেউ নিবেদন করেও ভালবাসা পায় না। যদিও দুটি ক্ষেত্রেই ভালবাসাটা একটা রূপক।
পরিশেষে বলতে হয় ছবি শেষ হয় এক অন্য ঘটনায় এসে, যে ঘটনার বহু আগেই মাস্টারদার ফাঁসি হয়ে গেছে। ছবি শেষ হয় কালাপানি থেকে ফিরে আসার পর কিশোর ঝুঙ্কুর আবার লড়াইয়ের গাঁথা দিয়ে। যে গাঁথা ইতিহাসের পাতায় তেভাগা আন্দোলন নামে পরিচিত হয়ে আছে। ছবির শেষ দৃশ্য একটা ঐতিহাসিক মুহূর্তের সৃষ্টি করে পর্দা জুড়ে ঝুঙ্কুকে ফ্রিজ করে দেওয়া হয়। আর নিচে লেখা যায় ঝুঙ্কুর সক্রিয় যোগদান তেভাগা আন্দোলনে। ছবির গল্পটা থেমে যায় কিন্তু সময় বয়ে চলে। আন্দোলন হয়, ভারত স্বাধীন হয়, নব্য ভারত গঠনের পরিকল্পনা হয়, রাজ্যে কমিউনিস্ট সরকার আসে, আমার জন্ম হয়, ঋত্বিক বাবুর মৃত্যু হয়, মৃত্যুর পর তার প্রথম ছবির মুক্তি হয়, নন্দীগ্রামের ঘটনা, সিঙ্গুরের ঘটনা রাজ্যে ৩৪ বছর পর কমিউনিস্ট সরকারের পতন ঘটায়, নতুন সরকার আসে, আমার জীবনেও জোয়ার আসে, দীর্ঘ ৫০ বছরের বেশি সাবেকি পুজো প্রথমবার থিমের রূপ দেখে—এই ভাবেই সময় এগিয়ে চলছে এগিয়ে যাবে আর এই এগিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে আমি যখন মাস্টারদার প্রতি নিজের শ্রদ্ধা নিবেদনের ক্ষেত্রে নিজের কোন অভিজ্ঞতা লেখবার কথা ভাবি তখন কিছুই খুঁজে পাই না তাই এ যাত্রায় আর তাকে উৎসর্গ করে কিছুই লেখা হল না। আসলে বড় স্থির সময় জন্মেছি কিছুই অস্থিরতা নেই সময় জুড়ে। তাই আর কিসের অভিজ্ঞতা থাকবে, কল্লোল বাবুর মত আমাদের মনি স্যার ও ছিলেন না যে লাল কাপড়ে মুড়ে বই এনে আমাদের মাস্টারদার কথা শোনাবেন, আর ওনার মত আমার তো ছোট ভাইপো ভাগ্নিও কেউ নেই যে তাকে অন্তত ইতিহাসের কথা শোনাবার জন্য আরেকবার তাকে নিয়ে এই সার্বজনীন আদিখ্যেতামির সময় ছবিটা আরেকবার দেখিয়ে আনতে পারি।
তাই এই “চিটাগাং” নিয়ে এই নিজের প্রকাশ বেদব্রত বাবুর পুত্র “ঈশান” কেই উৎসর্গ করলাম। তার আত্মার শান্তি কামনা করি, আর বেদব্রত বাবুর প্রতি আমার ভালবাসা ও শারদীয়ার প্রতি ও শুভেচ্ছা রইল। অনুরোধ শুধু একটাই যে এরপরের ছবি মুক্তির সময় কলকাতার মাল্টিপ্লেক্স ছাড়াও অন্য কোথায় অন্য কোন সিনেমা হলেও দয়া করে মুক্তি করবেন তা না হলে আমাদের মত অতি সাধারনের ক্ষেত্রে ...বুঝতেই পারছেন আর বেশি কিছু বললাম না। ভাল থাকবেন।।    

 ছবিঃ চিটাগাং
 প্রযোজনাঃ বেদব্রত পাইন
 অভিনয়ঃ মনোজ বাজপায়ি, নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকি প্রমুখ
পরিচালনাঃ বেদব্রত পাইন  

শনিবার, ২০ অক্টোবর, ২০১২



প্রেমের গন্ধে ব্রুনি





প্রিয় রং , প্রিয় মানুষ, প্রিয় অনুভুতি, প্রিয় মুহূর্ত ছবিতে ধরে রাখে তো সবাই কিন্তু এই প্রিয়দের গন্ধ কিছুতেই আমাদের কাছে থাকে না।প্রিয় বন্ধুর মৃত দেহে রাখা গোলাপের গন্ধে সেই যে খারাপ লেগেছিল আজ সেই খারাপ লাগা ছেড়ে গেলনা বলেই, গোলাপের গন্ধ আজও আমার ভীষণ অপ্রিয়। সরস্বতী পুজর দিন তোর হাত বেয়ে আসা গন্ধ আজও আমাকে হাঁটিয়েই চলেছে তুই পেরিয়ে আর দুরে। এই ভালবাসা বা এই খারাপ লাগা সব গন্ধ ধরে রাখতে পারলে অন্যরকম হত আমাদের চলা । গন্ধ এক অদ্ভুত আবেগ যার থেকে কিছুতেই দুরে থাকা সম্ভব নয়।



            ১৭০০ শতকের প্যারিস এর প্যাত্রিক সউকিন্দ এর গল্প তো এই গন্ধে আবর্তিত হয় ২০০৬ এর টম টোয়াইক এর ছবি “পারফিউম” এর মধ্যেI





হঠাৎ পাওয়া লেবুর গন্ধের উৎস এক সুন্দরী নারী হাতের অদ্ভুত গন্ধের পিছু নিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করা ছেলের জন্ম মাছ বাজারের নোংরার স্তুপে, অনাথ আস্রমে বেড়ে ওঠা শিশু কথা বলতে পারে না কিন্তু শুধু মাত্র গন্ধ শুঁকে সে আলাদা আলাদা ভাবে বুঝতে পারে মানুষ, গাছ , রাস্তা , পাথর । ১৩ বছর বয়েসে এক ট্যানারি মালিকের কাছে বিক্রি হয়ে “জন ব্যাপ্টিস্ট ব্রুনি” দিনে ১৬ ঘণ্টা কাজ করা ক্রীতদাসে পরিনত হলেও তাঁর গন্ধ শোঁকার যে আলাদা ক্ষমতা আছে তা ভালো ভাবে বুজতে পারে যখন সে আবিষ্কার করে যে , তাঁর নিজের কোনও গন্ধ নেই । মালিকের সাথে প্যারিস এসে এক বিরাট খোলা পৃথিবীর খোজ পায় , রাস্তা , মানুষ , খাবার, সুগন্ধি , ঘোড়া, বাড়ি, পাচিল,নারী , পুরুষ, ফুল , ফল, এমন কি সুন্দরের ।



যে সুন্দর হাতের পিছু নিয়ে আবিষ্কার করে এক অপুরূপা নারী কে যার শরীরে এক অদ্ভুত সম্মোহনী গন্ধ আছে , যে গন্ধের উৎস ব্রুনিকে জানতেই হবে কিন্তু  যদি মুহূর্তকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের অবচেতনে নিজের হাতেই দম আটকে মরে যায় সেই অচেনা নারী , তবে কি আমিও কি খুনি হব ?


আমিও তো গলা টিপে মেরেছি আমার ভালোবাসার গন্ধকে কিন্তু তারপর আমি তো ব্রুনির মত পাগল হয়ে কখনো চেষ্টা করিনি সেই গন্ধ কে নিজের কাছে সংরক্ষণ করে রাখতে , হয়ত মাঝরাতে জেগে গেছি সেই অনুভূতিতে; কিন্তু কোনও আতর শিল্পীর কাছে গিয়ে তো আব্দার করিনি যে আমার ভালোবাসার হারান গন্ধ বোতলে ভর্তি করে দাও , আমি বাতাসে নিয়ে ঘুরব আমার শ্বাস-প্রশ্বাসে।


জনপ্রিয় আতরে যে প্রেমের গন্ধ ব্রুনি কিছুতেই খুজে পায়না , অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছতে সে “বাওদিনি” নামের এক বিখ্যাত ইটালিয়ান আতর শিল্পীর সাথে কাজ করতে শুরু করে , এবং তাঁর গন্ধ শোঁকার বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে নতুন গন্ধ আবিষ্কার করে কিন্তু সে গন্ধে তাঁর নিজের প্রেম কিছুতেই খুজে পাওয়া যাই না । বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা চলতে থাকে , শহর জুড়ে চলতে থাকে এক এর পর এক খুন এবং খুন হয়ে যাওয়া প্রত্যেকে নারী । ভর্তি হতে থাকে ব্রুনির আতর এর বোতল । নিরীহ প্রেমিক ব্রুনি ক্রমশ হয়ে ওঠে এক ভয়ানক হিংস্র খুনি যে তাঁর প্রেমের গন্ধের আতর তৈরির উপকরন হিসাবে শুধু মাত্র নারী শরীরের গন্ধ ব্যাবহার করতে যে কোনও নারীকে খুন করতে পিছপা হয় না । বারবনিতা, ধনী মহিলা, মেশপালক, সুন্দরী ষোড়শী, চাষিস্ত্রী ; ব্রুনির প্রেমের আতরের উপকরন যে এদের সকলের মৃত শরীর ।


     প্রেমের ছবি ধীরে ধীরে নিশ্চিন্তে বদলে যেতে থাকে হিংস্রতায় , খুনের গন্ধে ক্রমশ গা ঘিন ঘিন করে ওঠে কিন্তু আতর তো সংগীতের মত তিন ধাপের মস্তিষ্ক , হৃদয় আর জীবন কে ছুঁয়ে যাই । প্রত্যেক একটা খুনের সাথে ব্রুনির বারোটি ছোটো শিশির এক একটা পূর্ণ হতে থাকে আর ব্রুনি কে খুজতে সারা শহর জুড়ে প্রশাসনের তৎপরতা । ব্রুনি ছুটে চলে নতুন নারী গন্ধের সাথে এক শহর থেকে আর এক শহরে । তাঁকে ধরার জন্য বিক্ষোভ শুরু হয় তবুও খুন থামেনা । বারো শিশি আতর পূর্ণ হলে ব্রুনি ধরা পড়ে সেই এই বারোটি আলাদা নারী শরীরের গন্ধ মিশিয়ে তাঁর প্রিয় নারীর প্রেমের গন্ধ সৃষ্টির মুহূর্তে ।

মিষ্টি প্রেমের গন্ধের খোঁজে যে ছবি শুরু হয়েছিল সেই ছবির শেষ লগ্নে এসে আমিও এই ব্রুনি কে কিছু তেই মেনে নিতে পারছি না , কিন্তু এতক্ষণ তো আমি এই ছেলেকে সফল হতে দেখতে চেয়েছিলাম কিন্তু কেন ছবিতে প্যারিস এর সাধারন মানুষের সাথে আমিও ব্রুনির মৃত্যু চাইছি । তাহলে আমি প্রেমের গন্ধ ধরে রাখতে পারিনি বলে আক্ষেপ করছিলাম সেই মানুষ তা কি মিথ্যা নাকি এই ব্রুনির সফর মিথ্যা ?


ব্রুনির বিচারের দিন আসে । প্রবল উত্তেজিত সাধারন মানুষের সামনে ব্রুনি কে আনা হয় হাতে ছোট্ট একটা শিশি নিয়ে । জল্লাদ এর সামনে দাড়িয়ে একটা রুমালে দু ফোঁটা প্রেম ঢালে এবং আকাশে বাতাসে উড়িয়ে দেয় সে গন্ধ , মুহূর্তের মধ্যে আবেশ ছড়িয়ে পড়ে , প্রেম বন্ধনে আবদ্ধ হয় সারা শহর , জল্লাদ , বিচারক, খুন হওয়া নারীর স্বামী, পিতা । সে এক জাদু মুহূর্ত। ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়ে খুনের শহরে, যে হিংসার জন সাস্তির আয়োজন হয়েছিল সেই স্থানে শুধু প্রেম ছড়িয়ে ব্রুনি শহর ছাড়ে ফিরে আসে নিজের জন্ম স্থান সেই মাছ বাজারে । নিজের মাথাতে ফোঁটা ফোঁটা প্রেম ঢালে , আলোকিত হয় ।মানুষ এক অজানা আকর্ষণে ছুটে আসে ব্রুনি আবার প্রেমিক হয়ে ওঠে , আমি শিউরে উঠি একি করল ব্রুনি ওর ছোট্ট শিশি ভর্তি যে প্রেম ছিল তা দিয়ে তো বিশ্বকে দাস করা সম্ভব , হিংস্রতা বন্ধ করা যেতো , প্রেমের নেশা তে বুদ করে রাখা যেতো নারী , পুরুষ কে। আমার ভাবনা শেষের আগেই ব্রুনি শরীর মাছ বাজারের মানুষ দের পেটে চলে যায়, ওই ক্ষুধার্ত মানুষেরা ব্রুনোর প্রেম মাখা শরীর খেয়ে অদ্ভুত তৃপ্তি লাভ করে।


রয়ে যায় শরীর বিহীন গন্ধ হীন প্রেম , আমি বুজতে পারি কেন ধরে রাখতে পারিনি আমার সময়কে আমার সেই প্রেমের গন্ধকে।

মঙ্গলবার, ৯ অক্টোবর, ২০১২

কালবেলা ---এ কালের ধারা আজও বয়ে চলে আমার বুক জুড়ে।





  জীবিত অথবা মৃত এই দুইই সত্ত্বা আমাদের। এর বাইরে আজ আমরা ভাবতে পারি না। প্রতি মুহূর্তে নিজের বাঁচার লড়াইটা লোরি। মৃত্যুকে আগলে রাখার যে ব্যর্থ প্রচেষ্টা প্রতি নিয়ত করে চলেছি, সেই লড়াইটা শুধুমাত্র নিজের সাথে নিজের লড়াই। আমরা জানি একসময় এসে আমরা হেরে যাবই, মৃত্যু আমাদের গ্রাস করবেই তা সত্ত্বেও লড়ে যাচ্ছি, আর প্রতি মুহূর্তে ভুলে যাচ্ছি একের সাথে অন্যের সম্পর্ককে। শুধু মাত্র সেই সম্পর্ক গুলিকেই মনে রাখছি যে সম্পর্ক ভালবাসার, যে সম্পর্ক স্নেহের, যে সম্পর্ক আদরের। আর সেই সম্পর্ক গুলো যে গুলোর কোন নাম নেই যে গুলোর কোন গন্ধ নেই তাদের প্রতি আমদের কোন দায়িত্ব নেই? এই দায়িত্ব গুলিই আজ যারা পালনের উদ্দেশ্যে পথে নেমেছে, তাদের প্রতি নিয়ত দূরে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে রাজনৈতিক অপরাধী আখ্যা দিয়ে। কোথায় আছি কেন আছি? এই প্রশ্ন কি কোনোদিন করে দেখার সময় হয়েছে? হয়নি। না আমার না আপনার। আমার সময় হয়েছে বলেই আমি আজ কলমকে আশ্রয় করে নিয়েছি। গুলি করতে না পারি কিছু গালাগাল তো দিতে পারি। নিজের মনের অভিমানকে আপনার মতন পুষে না রেখে তার বহিঃপ্রকাশ তো করতে পারি। এতে তো কিছুটা হলেও মনের শান্তি আসে। ঘোমটার তলা থেকে মুখ বের করে আনার সময় যে হয়ে এসেছে।
সমরেশ বসুর উপন্যাস অবলম্বনে গৌতম ঘোষের পরিচালনায় “কালবেলা” ছবিটা দেখতে বসেও আমার বারবার মনে হচ্ছিল একরাশ স্বপ্ন বুকে নিয়ে সেই সুদূর জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতায় পড়তে আসা অনিমেষের কি দরকার ছিল সেই স্বপ্নকে দূরে সরিয়ে রেখে মানুষের জন্যে লড়াই করবার জন্য রাজনীতিতে আসবার, বাবার বারণ করা সত্ত্বেও। আসলে ৭০ এর দশকের উত্তাল অবস্থা থেকে কেউ গা বাচিয়ে থাকতে পারে নি। কেউ প্রত্যক্ষ ভাবে সম্মুখ সমরে নেমেছে কেউ বা পরোক্ষ ভাবে।
কিন্তু একটা চরিত্র কি শুধুমাত্র মতবাদ পড়ে দলের নেতার উদ্দীপ্ত ভাষণ শুনেই সেই দলে যোগদান করতে পারে? তার নিজস্ব ধ্যানধারণা, ভাবধারা কি এর ফলেই সৃষ্টি হয়?  বিরোধী পক্ষের নীতিবিরোধীতা করাই কি সকল দলের উদ্দেশ্য? প্রশ্ন অনেক উত্তর নেই। আসলে উত্তর দেবার মত আজ কে কেউ নেই। আমিও তো চাইছি স্রোতের জোয়ারে গা না ভাসিয়ে একটা সুন্দর সমাজ গড়ে তোলবার। কিন্তু উপায় নেই, অন্যায় প্রতিবাদ করার শক্তি আমার নেই।
যে সত্তরের দশকের উত্তাল অবস্থার কথা আজ আমরা বাবা কাকা দের কাছে শুধু শুনি ইতিহাস ঘাটি না পড়ি না তারা হয়ত এ ছবি দেখে অনেক কিছুই বুঝবে না যেমন আমিও বুঝি নি তাই তাগিদ নিয়েই শুভঙ্করকে বললাম ৭০ দশকের ইতিহাসের বইটা দিতে।
অনিমেষ বাবার কাছে সেই যে অনুমতি নিয়ে কলকাতায় এল আসার সাথে সাথেই পায়ে বিনা কারনে পুলিশের গুলি খেয়ে অপরাধী হয়ে গেল আর সাথে সাথে কলকাতায় পড়তে আসা যে একেবারের মত শেষ হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু এ যাত্রায় সে দেবব্রত কাকুর জন্য বেঁচে গেল। কিন্তু আমি তো বাঁচতে পারলাম না, আমি ও তো স্বপ্ন দেখেছিলাম কলকাতার কলেজে পড়ব, কিন্তু যখন বিনা দোষে রাজনীতির স্বীকার হয়ে আমার সে স্বপ্ন ধুলিস্যাত হল, আমায় সে যাত্রায় কেউ বাঁচিয়ে দিল না, ফলে আমার স্বপ্নভঙ্গ হল, তাই প্রথম প্রথম জিনিয়াদের দেখলে যে বড় হিংসা হত। কিন্তু এ যাত্রায় আমিও যে অনিমেষের মধ্যে আমার আমিকে খানিকক্ষণ হলেও খুঁজে পেলাম। নিজেকে বেশ কিছুদিন বাদে খুঁজে পেয়ে আমার যে বড় আনন্দই হচ্ছিল।
যে অনিমেষ কলকাতায় এসে উত্তাল হাওয়ায় নিজেকে মেলে দিল, এক অসম বয়সি মহিলার সাথে গভীর বন্ধুত্বের বন্ধনে লিপ্ত হল, আর তার প্রেমিকের কাছে বকুনি খেল, এ হেন ঘটনা গল্পের ক্রমবিকাশে যথেষ্ট সাহায্য করলেও আমায় আবার ফিরিয়ে নিয়ে গেল আমার শৈশবের দিনগুলিতে যেখানে আমিও কাউকে প্রেম নিবেদন না করেই তার পূর্বতন প্রেমিকের কাছ থেকে কড়া ধমক খেয়েছিলাম। এ চিরচিরাচরিত ব্যাপার সময় বদলায়, প্রেমিকাদের রুপ বদলায়, যৌবন বদলায়, প্রেম করার আঙ্গিক বদলায় কিন্তু প্রেমিকদের মেজাজ মন বদলায় না তারা সেই একই থেকে যায় হীনমন্যতায় আজও ভোগে। আর এই জন্যেই আমি এদের থেকে আলাদা হতেই প্রবল বান এসে আমায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
অনিমেষ রাজনীতির ময়দানে নামল, মিটিং করল, নিজের ক্ষত চিহ্ন খুলে দেখাল, মিছিলে হাটলো, ক্লাস বয়কট করল---- আমি আবার আমার কৈশোরের দিন গুলিতে ফিরে চললাম যখন আমিও মিছিলে হেঁটেছি, মিটিংএ গেছি স্লোগান তুলেছি কিন্তু কোথায় স্থায়িত্ব খুঁজে পাই নিতাই অনিমেষ যখন দলের লোকজনের তাদের কার্যকলাপের ওপর আস্থা হারিয়ে সে দল ছেড়ে নতুন দলে যোগদান কোরে এক সশস্ত্র বিপ্লবের সূচনা করে আমিও আশায় বুক বাঁধি আমিও লড়ব আবার লড়ব মানুষের হয়ে লড়ব, মানুষের কাছে মানুষের হয়ে নালিশ জানাবো। নতুন এক বিপ্লবের সূচনা হবে। কিন্তু সুভাষ সেনের মত আমায় কেউ পথ দেখায় না নতুন রাস্তার কথা বলে না। তাই আমিও ভাবি আবার বিশ্বাস আনতে হবে, আবার উজ্জ্বল পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে হবে আমিও পারব নতুন করে মানুষকে আবার ফিরিয়ে আনতে আবার বিশ্বাস করাতে যে এ লড়াই মানুষের লড়াই শ্রেণিহীন সমাজের লড়াই।
বৈপ্লবিক আন্দলনের সাথে জড়িয়ে গিয়ে সেই আন্দলনের মাঝেই যখন অনিমেষের জীবনে প্রেম এল সেও যখন প্রেমের আলিঙ্গনে বিপ্লবের মাঝে প্রেমের কবিতা শুনতে চাইছে তার কবি বন্ধু ত্রিদিবের কাছ থেকে আমিও তার হয়ে দু চার লাইন শুনিয়ে দিলাম। কারন এ যাত্রায় আমিই ত্রিদিব আমিই অনিমেষ। কল্লোল বাবু যে অনেকদিন পর এসেছেন, আর তার কাছে সবসময় আবদার করাটাও সাজে না। তাই আমি লিখলাম আর আমিই পড়লাম---
               ফিরে আসা যৌবন আর উদ্দীপনার স্রোত
               ভাসিয়ে দেয় আমায়
               আমি ফিরে চলি, অন্ধকার গলি
               ফেলে আবার সেই তোমার মায়ায়।
               ভালবাসা দুহাত বাড়ায়
               মুখ তুলে একটু উঁকি দেয়
               কি করি আর কি যে না করি
               সবই এখন বোঝা দায়।।
অনিমেষের আন্দোলন সাধারনের জন্যে লড়াই, নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ভুলে মানুষের উন্নয়নের উদ্দেশ্যে নিজেকে অর্পণ করা, সাধারনের উদ্দেশ্যই যখন তার উদ্দেশ্য হয়ে দাড়ায়, আমিও ভাবি আমিও কেন পারি না নিজের ভাবনা গুলির বাহ্যিক প্রকাশ ঘটাতে, হয়ত সাহস হয় না পারিবারিক ও সামাজিক দুই ভয়েই নিজের মধ্যে নিজে লুকিয়ে থাকি। তাই অপেক্ষাকরি মাধবীলতার, যে এসে আমায় লতার মত জড়িয়ে ধরবে আর আমার ভাবনা গুলোর বাহ্যিক প্রকাশের পথ বলে দেবে। তুমি তো এসেছ সবে, হয়ত তোমার আর কিছুদিন সময় দরকার এ পথের হদিস জানবার, ভেবে আমায় জানিয়ো। আমিও ততদিন খুজি আমার ভাবনার পথ গুলোর সঠিক ঠিকানা কি।
ত্রিদিবের শব্দ আমার মনে গর্জন করে ওঠে আমিও মনে মনে ভাবি আমার শব্দও হয়ত আবার অন্য কারোর মনে গর্জন তুলবে। আবার হয়ত স্বর্গ থেকে বিনয় বাবু নেমে আসবেন আমার সাথে কথা বলবেন, আমায় সাবাসি দেবেন, উপহার স্বরূপ আমায় একটা “ফিরে এস চাকা” দেবেন, কিন্তু সে তো আমি কিনে ফেলেছি মাত্র ২০ টাকা দাম যে। বিনয় বাবুর সময়ও বোধহয় তাই ছিল। ত্রিদিবেরও কবিতার কোন হদিস পাওয়া যায় না, তার কবিতা কোথায় যায়, আদও কি সে ছাপার আকার নেয়? আমার তবুও ফেসবুক আছে মনের কথা কেউ কেউ শোনে সেখানে তবুও ছাপার গন্ধ যে আমায় বুকফাটা কান্নার হাত থেকে খানিক হলেও বাঁচিয়ে রাখে। আমি তো আর ত্রিদিবের মত সবকিছু ভাসিয়ে দিয়ে সামাজিক কবি হওয়ার পথে হাঁটব না। কারন এ সমাজ যে আমার পিছনেই আছে একটু কিছু বিরোধী হলেই ফ্রিডম অফ স্পিচ কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আমার ভাষা রোধ করে দেবে। কিছুদিন আগেই যেমন নোনাদাঙ্গার ওপর তথ্যচিত্রটা নিয়ে লেখাটাকে কেড়ে নিল। আমিও অসহায় ভাবে মেনে নিলামমৌনও মেনে নিল, এত কথা বলে কিন্তু এ যাত্রায় সেও হাত তুলে দিল। হাত তুলে দেওয়া ছাড়া ওর কাছে আর উপায়ও ছিল না। কিন্তু মৌন এভাবেই কি সারাজীবন আমাদের হাত তুলে চলতে হবে, আমরা কি পারব না কবিতা লিখে সকলের সামাজিক চেতনাকে জাগ্রত করতে, মুখোশ ধারী দের মুখোশ খুলে দিতে? তুই কি জানিস জানলে আমায়ও জানাস।
অনিমেষ যখন সশস্ত্র আন্দলনে যোগদান করে শান্তিনিকেতনে আসে সাথে মাধবিলতাও, ওই তো আমিও খোয়াইয়ের মধ্যে দিয়ে হাতছি, কিন্তু সাথে কে তুমি আমি যে ঝাপসা দেখছি আমি যে তোমায় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না, বিশ্বাস কর আমার সাথে অনিমেষের মত কোন অস্ত্র নেই, আমার যে কোন সুভাষ দা নেই যে আমায় অস্ত্র দেবে, আমি তো ওই ছাতিম গাছের তলায় পড়ব বলে এসেছিলাম, তুমি তোমার পরিচয়টা দাও না, আর ঝাপসা থেকো না এবার স্পষ্ট হও। আমার যে জানতে ইচ্ছা করে তুমি কে? কেন এসেছ? এই জিনিয়া ওকে জিজ্ঞেস কর না কে ও? কেন এসেছে?প্লিজ একবার জিজ্ঞেস কর।
অনিমেষের ছাত্র আন্দোলন রাষ্ট্র আন্দলনে পরিনত হয়। আর এখানেই আমি খেই হারিয়ে ফেলি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই কি হিংস্রতার লড়াই, সাধারন মানুষের লড়াই কি সমাজে হিংসা সৃষ্টি করতে পারে? তাহলে তো মৃণালদারাও আজ সমপরিমানে হিংসা ছড়াচ্ছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি ওদের সাপোর্ট করি কেন কারন ওদের লড়াইটা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হলেও যতই ওদের রাজনৈতিক অপরাধী ঘোষণা করা হক না কেন আমি জানি ওদের লড়াই ওই মানুষ গুলোর জন্য যাদেরকে রাষ্ট্র সুবিধাভোগী পণ্যে পরিনত করেছে। তাই আমিও তো ওদের লড়াইতে সামিল হতে চাই। তাই তো কলমটা তুলে নিলাম ওদের পথে সঙ্গী হব বলে। আমিও তো মনে করি—“কোই ভি দেশ পারফেক্ট নেহি হোতা উসে পারফেক্ট বানানা পরতা হ্যায়”।
যে গল্পের শেষে একজন রাজা আসে আর সব প্রজার সুদিন ফিরে আসে সেই গল্প তো আমাদের সকলের মনে আবার আশার সঞ্চার করবেই। তাই পঙ্গু হয়ে বহুদিন জেল খাটার পর তৎকালীন সরকার অনিমেষকে মুক্তি দেয় আর ও বস্তির সেই কুঁড়ে ঘরে মাধবীলতার সাথে ফিরে এসে নিজের ছোট ছেলেকে প্রথম বারের জন্য দেখে, ও আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়, আমার মনেও আবার আশার সঞ্চার হয়, তুমি হয়ত আবার ফিরে আসবে আবার আমার সাথে থাকবে। আবার আমরা নতুন করে জীবনের পথে লড়াই শুরু করব। ভালবাসা আবার এক দিগন্তবিস্তৃত নীল আকাশে চিৎকার করে বলবে “বিপ্লবের আরেক নাম মাধবীলতা”। তাই আমি অপেক্ষায় আছি তোমার ফিরে আসবার। আমি জানি তুমি ফিরে আসবেই। কি স্যার আসবে না আপনি তো সবসময়ই আমায় বুক বাঁধা আশার কথা বলেন এবার আর বলবেন না?
গল্প শেষ হয় জীবনের একটা চক্রাকার পর্যায়ের শেষ হয়। আমিও ভাবি এভাবেই হয়ত পর্যায়ক্রমে আবার আমাদের সুসময় ফিরে আসবে, আবার নতুন কোন রাজা এসে অভিষেকদা আর দেবলিনাদির মত মানুষদের মুক্তি দেবে। আমিও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ওদের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে হাজির হব আর ওদের লড়াইয়ের কথা শুনবো, ওদের প্রেমের কথা শুনবো, আর ওদের কানে কানে গিয়ে বলব আমিও তোমাদের মতন ভাবতাম কিন্তু তোমাদের মতন সাহস জুটিয়ে উঠতে পারলাম না। তাই এ যাত্রায় তোমাদের সঙ্গী হতে পারলাম না। মানুষের হয়ে মানুষের জন্য লড়াইটা করার প্রবল ইচ্ছে হয়ত ধামাচাপা পড়ল কিন্তু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে তার পথের খোঁজ করতেই লাগলো। সে পথের খোঁজ করতে গিয়ে এবার না হয় সে তার ভালবাসাটাই হারাল, তবুও তো আরেকটা জন্মে এসে এ ভালবাসার পুনরুদ্ধার করার একটা তিব্র আশা বুকে রয়ে গেল। সে জন্মে এসেও হয়ত কিছুটা হলেও আবার মানুষের অধিকারের কথা ভাবা হবে। আজ এই অব্ধিই থাক। এভাবে আর নিজেকে কতটা প্রকাশ করব। আমার যে মাধবিলতা নেই, যে তার উদ্দেশ্যে আবার দু চার লাইন লিখে ফেলবো। তাই এভাবেই খানিক প্রকাশ করলাম মাধবীলতার উদ্দেশ্যে, এ লেখা না হয় এবার তাকেই উৎসর্গ করা যাক।
 আমার শব্দ এখন জব্দ হয়ে গেছে প্রেম ভালবাসা ভুলে সে এখন অন্য নেশায় মেতেছে। তাই হয়ত কালবেলার অনিমেষ কোথায় আমার সাথে এক হয়ে গিয়েও শেষে এসে পুরোপুরি আলাদা হয়ে যায়। তাই কালবেলা একটা ছবিই থেকে যায় যা আমায় হয়ত চরম ভাবে উদ্দীপ্ত করে কিন্তু পথটা বলে দেয় না, যেমন বলে দেয় না শেষের পরিণতিটাও। আপনারা একটু ভাব্বেন আবার কোন অভিষেক, দেবলিনাকে রাজ দোষে গ্রেপ্তার করা হলে আপনারা কি এর প্রতিবাদে মিছিলে হাঁটবেন? না এবারের মতই তাদের অপেক্ষা করে থাকতে হবে আবার কোন নতুন রাজার। যে এসে তার প্রজাদের সুদিন ফিরিয়ে আনবে।
  

রবিবার, ৭ অক্টোবর, ২০১২


দিস ইজ ক্রিকেট


ভারতে ক্রিকেট একটা ধর্ম, যে ধর্মের দীক্ষিত লক্ষ লক্ষ মানুষ। কাইও ( ঋত্বিক/ রিতভিক সোরে ) তাদের একজন মুম্বাই তে থাকে বাবা আর ঠাকুরদা’র সাথে।এই বালকের সফর জুড়ে ছবি “ফেরারি কা সওারি”।


এ ছবি আসলে ক্রিকেটার এর ছবির থেকেও অনেক বেশী সাদা পোশাকের খেলাটার সততার ছবি। যে বার্তা “ যো দেখেগা ওই সিখেগা” বক্তব্যের মাধ্যমে ঘুরপাক খেতে থাকে সারা ছবি জুড়ে । ফলে ছবি শুরুর ২০ মিনিট পর থেকেও মানুষ হিসাবে আমাদের কেও প্রশ্নের মুখে দাড়াতে হয় আপোষ আর সততার। এছবি নিজের গতিতে ক্রিকেট কে কেন্দ্রে রেখে কখনো রাজনীতির মুখোশ কে আক্রমন করে তো কখনো আর্থসামাজিক ব্যবস্থা কে। এক স্কুলে পড়া বাচ্চার উত্তরণের ছবি হিসাবে আমাদের আবেগ শুষে নিয়ে ক্রিকেটীয় মহান ছবি হওয়ার সস্তা পথ ছেড়ে দিয়ে ছবি বিস্তার হল কখনো বাবা-ছেলের সম্পর্কে , যে সম্পর্ক শেষে গিয়ে রাজনীতির রং ধরে দেখাল সত্য কতটা জরুরি। বা কখনো পুলিশ –সাধারন মানুষ বা কখনো খেলোয়াড় এর নিজস্ব সব প্রতিবন্ধকতাতে।





কাইওর বাবা রুস্তম (সরমন যোশী) এক জন সাধারন সরকারি কর্মী , এ ছবি তো তারও পরীক্ষার , ছেলের স্বপ্ন পুরনে ছুটে বেড়ানো বাবা । যে বাবার হাত ধরে ছেলে ক্রিকেট মাঠে এবং মাঠের বাইরে সৎ হতে শেখে, সেই বাবা অবস্থার চাপে পড়ে অন্য রাস্তায় হাঁটতে চাইলে বদলে যেতে থাকে ছবির ভাষা এখানেই এক নতুন ন্যারেটিভের জন্ম দেন পরিচালক রাজেশ মাপ্সুকার । এ ছবি জুড়ে ক্রিকেটার সচিন তেন্ডুলকর এর বেড়ে ওঠার যে কাহিনী এতো দিন আমরা কাগজে পড়েছি তা এখানে স্পষ্ট তাই ছবি কিছুতেই সচিন এর ছায়া থেকে বেরতে পারে না ফলে বাধ্য হয়ে পরিচালক কে ম্যাজিক রিয়েলিসিম এর আস্রয় নিতে হয় । আর আমাকে আকর্ষণ করে স্টিল ছবির মাধ্যমে অতীত এর গল্প বলার পদ্ধুতি।



রাজ কুমার হিরানি এ ছবির ডায়ালগ লিখেছেন তাঁর আগের ছবির মত সব পাঞ্চ লাইন না হলেই বেশ কিছু সামাজিক বার্তা তিনি ছবির মাধ্যমে পৌঁছে দিতে পেরেছেন , তাই এ ছবি প্রমান করে যে আপোষ নয় পরিস্রম, প্রস্তুতি,  লড়াই আর সততা একমাত্র রাস্তা , যে রাস্তা সফল হতে গেলে প্রত্যেক কে পেরোতেই হবে।



অভিনয় এর জন্য বোমান ইরানি এ ছবির একটা অংশ , দাদুর চরিত্রে তিনি  অসুস্থ স্তবির কখনো রাগী , অভিমানি , আবেগ প্রবন , একজন রুক্ষ বিরোধী খিট খিটে মানুষ থেকে ছবির শেষের দায়িত্বশীল অভিভাবক হয়ে ওঠা পুরটাই অসাধারন।






কাইও না হই লড়াকু বাবা দাদু পেয়ে লড়তে শিখল, কিন্তু ক্রিকেটের এ দেশে হাজার হাজার  কাইও যে আজও ফুটে ওঠার আগেই ঝরে যায়, তাদের জন্য এ ছবি কি আশার আলো হয়ে থাকবে? আমরা কি শিখব কাইওর বাবার মত সমাজের কথা ভেবে সৎ থাকতে ? রাজনীতির মুখোশ খুলে কবে সাদা আর কাল চিন্তে শিখব ? কবে দৃষ্টি এতো সাফ হবে যে আর ভাঙ্গা চশমা দরকার হবে না? এমন বেশ কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে শেষ হয় “ফেরারি কা সওারি”।


আপনিও দেখুন এই উত্তর খুজতে নয় , এই সব দ্রুত গতির  প্রশ্নের সামনে ব্যাট হাতে আপনার দাঁড়ানোর সাহস আছে কিনা মেপে নিতে? নইলে ক্রিকেট যে আর জেন্টেল ম্যান্স গেম থাকবে না।  





পরিচালকঃ রাজেশ মাপ্সুকার । অভিনয়ঃ বোমান ইরানি , সরমন যোশী , ঋত্বিক/ রিতভিক সোরে। মিউজিকঃ প্রীতম।