শরতের হিমেল পরশ যখন সবার গায়ে তার শীতল স্পর্শ রেখে আগমনীর ধ্বনিতে মুখরিত
করে তুলেছে, নতুন পোশাকের লোভে সবাই যখন দোকানের সামনে লাইন দিয়েছে এমনই এক সোনালি
রৌদ্র মুখরিত দিনে সকাল বেলা শ্মশান থেকে এসে আবার দৌড়ে ছুটলাম ছবি দেখতে। বেদব্রত
পাইন পরিচালিত “চিটাগাং”।
ও হ্যাঁ এর আগের কথাটা বলি আগেরদিন সকালে শুভঙ্কর যখন বলল আগামিকাল ছবিটা
দেখতে যাবে, শুনেই আমার মুখের বাঁদিকে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। আমিও বেশ কিছুটা
মুহূর্ত ইতিহাসের সাক্ষী হবার লোভে, ইতিহাসকে আরও বিশদ ভাবে জানতে প্রথমে ছুটলাম
ছোট ভাইয়ের কাছে, ওর ইতিহাস বইয়ের পাতায় একবার আবার ঘটনার বিবরন পড়বার আশায়। পাতার পর
পাতা উল্টোলাম কিন্তু মাত্র ২ টো লাইনের বেশি খুঁজে পেলাম না। যদিও খুব বেশি পাতা
উল্টোতে হয় নি কারন পাতা উল্টানো শুরু হতেই না হতেই তা শেষ হয়ে যায়। আমদের
ছোটবেলায় আমরা যে বৃহৎ আকারের ইতিহাস বই পড়েছিলাম তাতেই মাত্র কয়েকটা অনুচ্ছেদ ছিল
আর এখন তো খাতার থেকেও পাতলা বইতে এর থেকে আমি বেশি কি আশা করতে পারি। সব কিছুতেই
পরিবর্তন শিক্ষা থেকে কৃষি, কৃষি থেকে বাণিজ্য, বাণিজ্য থেকে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সব
কিছুতেই এক চরম বাহ্যিকরনের তীব্র প্রয়াস।
আমি এতক্ষন ইতিহাসের যে পাতাটার কচকচানি করছিলাম তা হল ব্রিটিশ শাসনাধীন
ভারতে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ও মাস্টারদা সূর্য সেন। কিভাবে মাস্টারদা তার
কয়েকজন সহচর তথা বিপ্লবী নির্মল, গণেশ,
অনন্ত প্রীতিলতাদের নিয়ে ও প্রায় ৬০ এর কিছু বেশী তার কিশোর ছাত্রছাত্রী দের নিয়ে
ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি নামে যে দল গঠন করেছিলেন ও চট্টগ্রামকে একদিনের জন্য
স্বাধীনতার ছোঁয়া দিয়েছিলেন, শেষে যুদ্ধে ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হয়ে
নিজে ফাঁসির মালায় নিজেকে সমর্পিত করেছিলেন। এই ইতিহাসই আমদের পাঠ্য বইতে ছিল এর
বেশী কিছু না এর বেশী আশা করাটাও বোধহয় বৃথা। যে বইতে বাঘাযতিন সম্পর্কে শুধু নাম
ছাড়া আর বেশী কিছু পাওয়া যায় না সেই বইতে মাস্টারদার সম্পর্কে এত কিছু লেখা হয়েছে
এ মাস্টারদা চরম সৌভাগ্য।
তাই এক বুক হতাশা নিয়েই ছবিটা দেখতে গেলাম। কিন্তু এক পরম আনন্দ আমায় অভিভূত করল যখন এক অন্য ইতিহাস আমি জানতে
পারলাম। এক কিশোরের চোখ দিয়ে আমি যখন মাস্টারদাকে দেখতে পেলাম। এখানে মাস্টারদার
ইতিহাস ছবির গল্প নয়। এখানে মাস্টারদা কিভাবে একজন কিশোরকে প্রভাবিত করেছিল যে সে
তার বিদেশ যাত্রা ত্যাগ করে দিয়ে মাস্টারদার দলে যোগদান করেছিল ও কাঁধে কাঁধ
মিলিয়ে লড়েছিল। বেদব্রত পাইন পরিচালিত ও প্রযোজিত “চিটাগাং” এক কিশোরের
গল্প, তার লড়াইয়ের গল্প, তার অনুপ্রেরিত হওয়ার গল্প। “চিটাগাং” আসলে সুবোধ ঘোষের
গল্প, ঝুঙ্কুর গল্প।
যে মাস্টারদা এতদিন আমাদের কাছে তার নিজ আঙ্গিক দিয়ে শ্রেষ্ট ছিলেন এবার
তার শ্রেষ্টত্ত একজন কিশোরের চোখ দিয়ে দেখান হল, যেখানে কখন ছবি জুড়ে তিনি
প্রাধান্য বিস্তার করে থাকেন না। তার লড়াইয়ের দৃশ্যও বড় মৃদু। ছবি জুড়ে শুধুই
ঝুঙ্কুর চোখ ঘুরে গেছে এদিক থেকে সেদিক, আর সে দৃষ্টি সর্বদাই মাস্টারদাকে কখন
সামনে থেকে আবার কখন পিছন থেকে জড়িয়ে রেখেছে।
মাস্টারদার লড়াই কৌশল তাই এখানে প্রধান বিষয় নয়। তাই চরিত্রচিত্রায়নে
মাস্টারদা যথাযথই। গল্পটা আমরা যার গলায় শুনি যার চোখে দেখি সেই ঝুঙ্কুই এখানে
প্রধান চরিত্র। তাই যখন একজন বিপ্লবীকে ব্রিটিশদের হাতে খুন হতে দেওয়ার ঘটনায় সবাই
যখন ঝুঙ্কুকে দোষী বলে বিবেচিত করে মাস্টারদা তার শিষ্যের হাত ধরে ঘোষণা করে তিনি
জানেন এ কাজ সে করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে আমরা আদও জানতে পারি না যে সে ব্রিটিশদের
সেই বিপ্লবীর কথা বলে দিয়েছে কিনা কিন্তু মাস্টারদার আশ্বাসবাণী আমাদের মনকে
আশান্বিত করে। বোধহয় মাস্টারদার যে চিত্র আমাদের মনে অঙ্কিত ছিল সেটাই আমাদের
বুঝতে আরও সুবিধা করে দেয়।
নাসার চাকরি ছেড়ে প্রথমবার ছবি করতে আসা নবীন পরিচালক বেদব্রত পাইন তার
প্রথম ছবিতেই অনেক কম বাজেটে যা ফুটিয়ে তুলেছেন এককথায় অনবদ্য না হলেও যথেষ্ট ভাল।
তবে ৩৬ বার চিত্রনাট্য বদলের পর চিত্রনাট্যে বেশ কিছু ফাঁকফোকর ধরা পড়ে। আমরা ছবির
শুরুর দিকে বুঝতে পারি না মাস্টারদা কে? হ্যাঁ যারা ইতিহাস জানেন তারা তো নিশ্চয়
জানবেন কিন্তু যারা পাশের সিটে বসা প্রেমিকযুগলের অন্তরঙ্গ মুহূর্তকে লকলকে জিভ
বের করে দেখতে যায় তাদের জন্য অন্তত পারতেন মাস্টারদাকে এস্টাব্লিস করতে। তাহলে
হয়ত কোনার সিটে বসা
প্রেমিকযুগলের বেরোবার সময় এত মুখ লুকিয়ে বেরোনোর প্রয়োজন পড়ত না। আরও একটা
বিষয় যেটা আমারও বুঝতে একটু অসুবিধা হয়েছে,কারন কি বলুন তো একটা ইতিহাসের সাক্ষী হতে গিয়ে আমিও খুব বেশি কিছু
জেনে যেতে পারিনি। তাই ঝুঙ্কুর সাথে মাস্টারদার সম্পর্ক ও তার ওপর মাস্টারদার অগাধ
বিশ্বাসের কারন আমি বুঝতে পারি না। আমি শুনতে চাই মাস্টারদার সেই উদ্দীপ্ত করা কথা
যা শুনে সদ্য কৈশোর পেরনো ছেলেরাও তার দলে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু সারা ছবি জুড়ে আমি
সেই কথা কে বড় মিস করি। আমার আর উদ্দিপনা আসে না শুধু ওদের হেরে যাওয়া দেখে দুচোখ
বেয়ে জল পড়ে। আমি ওদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে পারি না মুখ বুজে থাকি জানি কোনদিনও
পারব না।
আরও একটা বিষয় খুব চাক্ষিক ব্যাথার সৃষ্টি করে তা হল হঠাৎ করে এসে পড়া
দৃশ্য। জাম্পকাট ব্যাবহারের সময় আর একটু
সক্রিয় থাকার বোধহয় প্রয়োজন ছিল, তা হলে এই হঠাৎ করে এসে পড়া দৃশ্য গুলির মধ্যে
একটা সরলরৈখিক মিল খুঁজে পাওয়া যেত।
ছবি জুড়ে যে সঙ্গীত পরিবেশিত হয় তা ছবিকে এক আলাদা মাত্রায় উপস্থাপিত করে।
শঙ্কর- এহেসান- লয় এর সুরে বোলো না গানটি ছবির চরিত্রদের অনেক না বলা কথাকে আমাদের
সামনে আমাদের মনে শব্দের আকার দিয়ে দেয়। প্রসুন যোশির কথা নির্মল আর প্রীতিলতার
ভালবাসাকে, তাদের মিলনের বিরহকে কোথাও ধুয়ে মুছে রেখে শুধুমাত্র বারবার আবেদন করে
একে অপরকে তাদের একে অপরের প্রতি ভালবাসা নিবেদনের জন্য। অবাক করে আমায় কেউ চাইলেও
তার ভালবাসাকে নিবেদন করতে পারে না আবার কেউ নিবেদন করেও ভালবাসা পায় না। যদিও
দুটি ক্ষেত্রেই ভালবাসাটা একটা রূপক।
পরিশেষে বলতে হয় ছবি শেষ হয় এক অন্য ঘটনায় এসে, যে ঘটনার বহু আগেই
মাস্টারদার ফাঁসি হয়ে গেছে। ছবি শেষ হয় কালাপানি থেকে ফিরে আসার পর কিশোর ঝুঙ্কুর
আবার লড়াইয়ের গাঁথা দিয়ে। যে গাঁথা ইতিহাসের পাতায় তেভাগা আন্দোলন নামে পরিচিত হয়ে
আছে। ছবির শেষ দৃশ্য একটা ঐতিহাসিক মুহূর্তের সৃষ্টি করে পর্দা জুড়ে ঝুঙ্কুকে
ফ্রিজ করে দেওয়া হয়। আর নিচে লেখা যায় ঝুঙ্কুর সক্রিয় যোগদান তেভাগা আন্দোলনে।
ছবির গল্পটা থেমে যায় কিন্তু সময় বয়ে চলে। আন্দোলন হয়, ভারত স্বাধীন হয়, নব্য ভারত
গঠনের পরিকল্পনা হয়, রাজ্যে কমিউনিস্ট সরকার আসে, আমার জন্ম হয়, ঋত্বিক বাবুর
মৃত্যু হয়, মৃত্যুর পর তার প্রথম ছবির মুক্তি হয়, নন্দীগ্রামের ঘটনা, সিঙ্গুরের
ঘটনা রাজ্যে ৩৪ বছর পর কমিউনিস্ট সরকারের পতন ঘটায়, নতুন সরকার আসে, আমার জীবনেও
জোয়ার আসে, দীর্ঘ ৫০ বছরের বেশি সাবেকি পুজো প্রথমবার থিমের রূপ দেখে—এই ভাবেই সময়
এগিয়ে চলছে এগিয়ে যাবে আর এই এগিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে আমি যখন মাস্টারদার প্রতি
নিজের শ্রদ্ধা নিবেদনের ক্ষেত্রে নিজের কোন অভিজ্ঞতা লেখবার কথা ভাবি তখন কিছুই
খুঁজে পাই না তাই এ যাত্রায় আর তাকে উৎসর্গ করে কিছুই লেখা হল না। আসলে বড় স্থির
সময় জন্মেছি কিছুই অস্থিরতা নেই সময় জুড়ে। তাই আর কিসের অভিজ্ঞতা থাকবে, কল্লোল বাবুর
মত আমাদের মনি স্যার ও ছিলেন না যে লাল কাপড়ে মুড়ে বই এনে আমাদের মাস্টারদার কথা
শোনাবেন, আর ওনার মত আমার তো ছোট ভাইপো ভাগ্নিও কেউ নেই যে তাকে অন্তত ইতিহাসের
কথা শোনাবার জন্য আরেকবার তাকে নিয়ে এই সার্বজনীন আদিখ্যেতামির সময় ছবিটা আরেকবার
দেখিয়ে আনতে পারি।
তাই এই “চিটাগাং” নিয়ে এই নিজের প্রকাশ বেদব্রত বাবুর পুত্র “ঈশান” কেই উৎসর্গ
করলাম। তার আত্মার শান্তি কামনা করি, আর বেদব্রত বাবুর প্রতি আমার ভালবাসা ও
শারদীয়ার প্রতি ও শুভেচ্ছা রইল। অনুরোধ শুধু একটাই যে এরপরের ছবি মুক্তির সময়
কলকাতার মাল্টিপ্লেক্স ছাড়াও অন্য কোথায় অন্য কোন সিনেমা হলেও দয়া করে মুক্তি
করবেন তা না হলে আমাদের মত অতি সাধারনের ক্ষেত্রে ...বুঝতেই পারছেন আর বেশি কিছু
বললাম না। ভাল থাকবেন।।
ছবিঃ চিটাগাং
প্রযোজনাঃ বেদব্রত পাইন
অভিনয়ঃ মনোজ বাজপায়ি, নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকি প্রমুখ
পরিচালনাঃ বেদব্রত পাইন
lekha ta bes valo hoeche...
উত্তরমুছুনধন্যবাদ সুমিত।
উত্তরমুছুন