বুধবার, ২ জানুয়ারী, ২০১৩


ফের চলে যাবে করে একলা আমাকে



অগুনতি তারে আটকে ছিলাম , বাইরে পারদ খুব দ্রুত নিচে নামছিলও ,এর মধ্যে আমার ছ’বছরের পুরনো সেল ফোনে একটা এসএমএস এলো“আজ বিকাল তিনটেয় ময়দান , রোদে পিঠ দিয়ে বসবো । আজও যদি দাড় করিয়ে রেখেছিস খুব মার খাবি কিন্তু । প্লিজ ভুলে যাস না যেন আমি আজ কিন্তু রিহার্সাল যাব না' তোর জন্য” আমি তাড়াতাড়ি ছুটি চেয়ে পাড়ি দি ময়দান। দেরি হলে যে আবার আয়ত চোখের শাসন জুটবে খুব করে।  আসলে এ সম্পর্কের যে নাম দেওয়া যায় না বন্ধুত্বের থেকে বেশী আবার প্রেমের থেকে কম।


ফিরতি পথে ভাবছিলাম এমন সম্পর্ক এ শহরের পাজরে প্রতিদিন নতুন রঙ নিয়ে আসে বলেই আজও অসময়ে বৃষ্টি হয়। ভাবছিলাম এমন বিষয় নিয়ে কেন ছবি হয় না। কান , বার্লিন , টরেন্টো তে যারা বাংলা ছবি পাঠান তারা এমন “বোকা–নন ইন্তেলেকচুয়াল” বিষয় নিয়ে ভাবেনা না । আর যারা ওখানকার জন্য ছবি বানান না তাদের ছবি তো আবার টার্গেট অডিয়েন্স এর জন্য হিরো কে প্রচণ্ড মারপিট করতে হবে , ভীষণ নাচতে হবে সে এক ভীষণ জটিল ঘটনা বটে।




এসব ভাবতে ভাবতে আজ দেখে ফেললাম “বোঝে না সে বোঝে না” । এবং দেখলাম অসাধারন এক গল্প বলেছেন রাজ চক্রবর্তী। সম্ভবত তার এখন পর্যন্ত সেরা ছবি । যার প্রতিটা কোনায় কোনায় উকি মারে বাংলা , উকি মারে আপনার প্রথম যৌবন এর অনুভুতি । একটা অ্যাক্সিডেন্ট , অনেক নাম না জানা সম্পর্ক আর ঘরে ফেরার টান দিয়ে বোনা এছবি।  নুর মুর্শিদাবাদ এর ছেলে প্রেমে পড়ে ছটফটে মেয়ে রিয়ার । নুর নিরীহ সুবোধ বালক যে লেদ কারখানাতে কাজ করে আর রিয়া খুব ছটফটে স্মার্ট নার্স । সারা ছবি জুড়ে অদ্ভুত তাদের বিচরন । নুর এর ওপর রিয়া এক এর পর এক প্রেম এর অত্যাচার করতে থাকে বাদ যায় না কিছুই , সে রিয়ার পুলিস অফিসার বাবা হোক বা ছ’বছরের অপছন্দের ছেলেকে দিয়ে মার খাওয়ানো । এখানেই পরিচালক আসল খেলা টা খেলেন নুর এক রক্ত মাংসের মাসে ছ’হাজার টাকা উপার্জন করা লোক সে কিছুতেই সুপার হিরো হয়ে ওঠে না । সে মারামারি করতে পারে না , মদ খেতে পারে না, বান্ধবী কে জড়িয়ে ধরতে পারে না , এমন কি ঠিক ভাবে প্রপোজ ও করতে পারে না তবু সে একটা জিনিষ পারে “ ভালোবাসতে”। আপনার আমার মত মানুষ যে শুধু ভালবেসে যেতে পারে নাই বা থাকল সেখানে শহুরে চালাকি । মালদা পর্বের এই অংশে রাজ যে মালদা কে তার চোখে ধরেছেন টা কিন্তু বাংলা ছবি থেকে বহু বছর আগে হারিয়ে গেছে । অসামান্য সেই পুরনো ইটের শহর এখানে খুব জীবন্ত , কাশ ফুল , আর ধান খেত আর জল ভর্তি ঝিল।
   

বাস দুর্ঘটনা দিয়ে শুরু হওয়া ছবি আসলে আমাদের প্রেমের সফর করাতে থাকে ছবি জুড়ে যেখানে আমরা পরিচিত হই বালুরঘাটের এক মেয়ের সাথে যে প্রথম বার কলকাতায় এসে পথ চিনতে সাহায্য নেয় কোলকাতার এক ছেলের থেকে সে পথ চলা একেবারে কোলকাতার যেখানে জীবন্ত ধর্মতলা থেকে সেক্টর ফাইভ সব খুব প্রতিদিনের মত করেয় ধরা দেয়।  আমরা চিনতে পারি ছবির শেষে গিয়ে মেয়েটি জয়ী আর ছেলেটি অভীক। যে পথ হারানোতে তাদের প্রথম পরিচয় সে পথ তাদের আবার মিলিয়ে দিল এক মৃত্যু আবর্তে। প্রত্যেক চরিত্র আমাদের ভাষা তে কথা বলে বলেই জয়ী বলে উঠতে পারে “গালে কাটা দাগওয়ালা ছেলেটি কোলকাতার হলেও ভালো ছেলে , প্রথমে বিশ্বাস হচ্ছিল না এখন তো বেশ ভরসা হচ্ছে , কখনো বালুরঘাট এলে আমাদের বাড়িতে আসবেন কিন্তু” বা রিয়া বলতেই পারে “ তুমি তো আমার চেনা কেউ না তাই রক্ত পরীক্ষা করে দেখে নিলাম তোমার এইডস আছে কিনা”


ছবির শেষ টা বলা উচিত হবে না তবে “বোঝে না সে বোঝে না” গানটি যদি ছবির অনুভূতির প্রমান হয় তবে “ না রে না” কিন্তু পরিচালক এর ম্যাজিক, ক্রমশ সংক্রমিত হচ্ছে এই পিকনিক মরসুমে। আর যান্ত্রিক সুবিধা যে শুধু মাত্র হিরোগিরীতে ব্যবহার এর ভুল ধারনা ভেঙে দিলেন পরিচালক বাস এক্সিডেন্ট এর দৃশ্যে। শেষ তিন বছরে এতো শক্তিশালী এক্সিডেন্ট এর চিত্রগ্রহন বাংলা ছবিতে হয়নি। পুরো ছবি দিনের আলতে সুট হয়েছে তাই ছবি জুড়ে আলো এক অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করে চলে ফ্রেম থেকে ফ্রেমে ।আর ছবি শেষের পর এমনিতেই গুন করে ওঠে

         
“ এটা গল্প হলেও পারত ,
একটা আধটা পড়তাম,
খুব লুকিয়ে বাঁচিয়ে রাখতাম তাকে;
            
জানি আবার আসবে কালকে,
নিয়ে পালকি পালকি ভাবনা,
ফের চলে যাবে করে একলা আমাকে।”


মিলে যেতে থাকে আমাদের অনেক অনেক না বোঝা কথা। বুজতে পারি কেন আদিত্যর প্রোফাইল পিকচারে কেউ লিখে ফেলে “ আবার সেই পচা জামাটা পরেছে” কেন আমদের প্রিয় শিক্ষক তার শতছিন্ন ফোন টা এখনও বাদ দিয়ে স্মার্ট ফোন কেনেন না। বুজতে পারি কেন স্বর্নাঙ্ক গঙ্গার দিকে তাকিয়ে উদাস হয়ে বলতে পারে “ ভালবাসা আসলে অনুভুতি যাকে আতর এর মত অনুভব করতে হয়” কেন চুল বড় রাখা সুভঙ্কর এক আকাশ বৃষ্টি মাথায় উন্মাদ এর মত মেট্রো স্টেশনের দিকে ছুটে গিয়েও না ঢুকে ফিরে ঠায় দাড়িয়ে থাকে। কেন আয়ত চোখের জিনিয়া আমাকে মেরে , খিমচি কেটে , শাসন করে , খিস্তি করার পর ,বলে “আজ তোকে টাকা দিতে হবে না আমি খাওয়াচ্ছি” , কেন গভীর রাতে এসএমএস করে বলে “আজ আবার তুই অন্য মেয়েকে ফিল্ম মুভমেন্ট বুঝিয়েছিস? তোকে নিয়ে আর পারি না মৌন” ছবিটি শেষ হয়েও শেষ হয় না চলতে থাকে এভাবেই।


    
বিদেশে গান বা ছবি বানানোর অষ্টমী চলছে এখন বাংলা ছবিতে। সেখানে রাজ চক্রবর্তী ভীষণ সফল ভাবে ধরেছেন মালাদা শহর কে , তার ঐতিহ্যকে, ইমারতকে আসলে এছবি যে শুধু প্রেমের নয় । এতো হালি শহর থেকে এক বুক স্বপ্ন নিয়ে কোলকাতাতে পাড়ি দেওয়া এক মানুষের ছাপ , ছবি বানানোর লক্ষে যার দিনের পর দিন একটা মেস বাড়িতে বাকি অভিনেতা বন্ধুদের সাথে ঠেসে থাকা। ফলে সেই মানুষ যখন ছবি বানান তাতে গ্রাম বাংলা থাকবেই, নুর ,রিয়া , জয়ী , অভিক এর মত খুব সাধারন অনুভুতি প্রবন রক্ত মাংসের মানুষ রা জীবন্ত হয়ে উঠবেন। আসলে মফস্বল এর মানুষদের যে বন্ধুত্বের কোনও পর্ব নেই , কোনও জাত নেই , ক্যাবলা বা বুদ্ধিমান এর মত ফারাক নেই আসলে বন্ধুত্বে যে এসব হয়না। ধন্যবাদ রাজ চক্রবর্তী কে এমন ছবির জন্য , এছবি যে আমার মত অনেক ছেলেকে সাহশী করে তোলে যারা ভোরের ট্রেন ধরে ছবি বানানোর স্বপ্ন নিয়ে কোলকাতা আসে আর দিনের শেষে সব হাউস ঘুরে কাজ না পেয়ে গভীর রাতের ট্রেনে খিদে পেটে বাড়ি ফেরে, কাল আবার এই ভাবতে ভাবতে।
     

 পরিচালক- রাজ চক্রবর্তী
প্রযোজনা- শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্ম
অভিনয়ে- সোহম, মিমি চক্রবর্তী, আবীর চট্টোপাধ্যায়, পায়েল সরকার , 
যুধাজিৎ ব্যানার্জি   প্রমুখ

২টি মন্তব্য:

  1. lekhar por mayb porisni tai lekhata thik guchano mone hocche na.KEEP IT UP,porer lekha taratari porar asai roilam..

    উত্তরমুছুন
  2. তুই তো critic নোস,খ্যাপা প্রেমিক...নিয়ম মানিস না!!

    উত্তরমুছুন