রবিবার, ১৬ জুন, ২০১৩


ঋত্বিক ঘটককে লেখা এক খোলা চিঠি-



কী বলে সম্বোধন করব ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না আসলে চিঠি লেখার অভ্যেস আমাদের কোনোকালেই ছিল না আমরা হলাম সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং এর প্রজন্ম আমদের দৌড় ওই মসজিদ পর্যন্ত আর ভনিতা না করে আপনাকে কাজের কথা বলি



আচ্ছা, আপনার অহল্যাকে মনে আছে নিশ্চয় সেই কাকদ্বীপের মেয়েটি যাকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছিল, আর কাকদ্বীপ হয়ে উঠেছিল মুক্তাঞ্চল আপনিও তো কেঁদেছিলেন সেই সময়, পাগলের মতো স্বপ্নে, মৃতদেহ নিয়ে ছুটেছিলেন প্রতিকারের আশায় জানেন সে তো অনেক বছর হল তখন এক অহল্যার জন্য আপনি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন আজ থাকলে কি করতেন? আপনি বোধহয় লজ্জায় আত্মহত্যাই করতেন জানিনা ঠিক কী করতেন আজ রোজ একটা করে ধর্ষণ হয় ঋত্বিকবাবু আর তারপর তাকে টুঁটি টিপে মেরে ফেলা হয় পরিবারের লোক কান্নায় হতাশায় ভেঙে পড়েন, আমরা খবরের কাগজে পড়ে আবার মুড়িয়ে সেটাকে যথাস্থানে রেখে দি, আর সরকারি আমলারা পরিবারের লোকেদের চাকরি দেবার কথা বলে সেই স্কুলে থাকতে ধনঞ্জয়য়ের ফাঁসি হয়েছিল দেখেছিলাম, তারপর আর তেমন কিছু শুনিনি অথচ দিল্লির দামিনী, পার্ক ষ্ট্রীটের মেয়েটি, বারাসাতের নাম না জানা অনেকে, কাল কামদুনি, আজ গাইঘাটা, একের পর এক হয়ে চলেছে আপনার মতো নারীকে আজ আর কেউ দেবী রূপে দেখেনা নারী আজ প্রয়োজনীয় চাহিদার ভোগ্যপণ্য অথচ একটু ভেবে দেখেলে বোঝা যায় যে নারীর মায়াতেই আমরা পুরুষেরা বেঁচে আছি থাক আর বেশী কিছু বলে কি হবে যা হচ্ছে হয়ে যাবে, এইভাবেই চলবে যতই চেল্লামেল্লি হোক মানুষের পাশে দাড়িয়ে সহযোগিতা করা মানুষ আজ ভুলে গেছে মানুষের জন্য কেউ কিছু করতে চায় না আপনার মতো কেউ পিপলস আর্টিস্ট নেই সবাই এখন শেল্ফ আর্টিস্ট



এই প্রসঙ্গে আসি আপনাকে নিয়ে একটা ছবি বেরিয়েছে আপনার ছবির নামাকরনেইমেঘে ঢাকা তারা পরিচালক কমলেস্বর মুখোপাধ্যায় জীবিত কালে তো কিছুই পেলেন না মৃত্যুর এতদিন পর না হয় ভালোবাসার অনুপ্রদান ছবিতো কেউ দেখেনি আপনার, আপনার লেখাতেই পড়েছি, কেউ বোঝেনি আপনার ছবি আর দেখুন এখন আপনাকে দেখার জন্য কী তোড়জোড় বাঙালির আঁতলামোটা মূল্যবৃদ্ধির মতো দিনের পর দিন বাড়ছে শুনেছিলাম আপনি নেশাগ্রস্থ ছিলেন কিন্তু মাইরি বলছি ছবিটা না দেখলে সত্যিই জানতে পারতাম না আপনি এই হারে বাংলা টানতে পারেন আর সাথে বিড়ি সিগারেট পর্যন্ত খেতেন না, এত অভাব ছিল, সরকারি টাকায় তো শুনেছিলাম বেশ কিছু তথ্যচিত্র বানিয়েছিলেন, গাড়িও কিনেছিলেন পড়েছিলাম, কিন্তু এখানে যে দেখলাম আপনার সংসারের দৈন্য দশা খেতেও পারেন না ঠিক ভাবে কিজানি বাপু ঠিক বুঝতে পারিনা প্রথম জীবনে তো গণনাট্য করতেন তারপর ছবিতে এলেন তো আর তাছাড়া আপনি তো বিখ্যাত ঘটক পরিবারের ছেলে ছিলেন, তাহলেও এই দুর্দশা ছিল! ঠিক আছে চলো দুঃখ আমাদের সকলের সঙ্গী আছে থাকুক

চলুন এবারে আপনাকে ছবির কথাটা বলি যেহেতু ছবির বিষয়বস্তু আপনি, কিন্তু আপনার জীবনী নিয়ে ছবি নয় শুধুমাত্র সেই সময়টা নিয়ে যখন আপনি পাগলাগারদে আর বদ্ধ উন্মাদদের নিয়ে নাটক করার কথা ভাবছেন আপনার এই সময়ে বারেবারে আপনি ফিরে গেছেন আপনার অতীত জীবনে কীভাবে আপনি এলেন এই পাগলাগারদে সোজা কথা উন্মাদ ছিলেন তাই এলেন কিন্তু উন্মাদ হলেন কেন শিল্পী তো, ক্ষ্যাপা তো হবেনই, ক্ষ্যাপামো ছাড়া কি শিল্পটা হয়? কিন্তু ছবিতে দেখি আপনার শিল্পকর্ম ছাড়া আর বাকি সবকিছু শিল্প করার ঔদাসিন্যতা ছাড়া বাকি সব কিছু থাকে আপনার ভাবনা চিন্তা, নাটকের প্রতি ভাবধারা, সমাজ সংস্কারক হিসাবে নিজেকে মেলে ধরা কিন্তু বিশ্বাস করুন আপনাকে খুঁজে পাইনা যে ঋত্বিক বলতে পারে আমি সিনেমার প্রেমে পড়িনি, সিনেমাকে নিজের হাতিয়ার হিসাবে ব্যাবহার করি সেই ঋত্বিক নেই ছবিতে



আমরা তো সবাই জানি আপনি মেনে নিতে পারেন না ৪০ লক্ষ মানুষের পিঠে ছুরি বসিয়ে দেশভাগ করে দেশ স্বাধীন হওয়ার আনন্দ যে বাংলাকে ভাঙলো ওরা, আপনি তা মেনে নেননি আপনার কথা মতো আজও আমরা বলি বাংলার আবার এপার ওপার কী কিন্তু বিশ্বাস করুন আজকে ২০১৩ তে এসে এসব নিয়ে কেউ ভাবে না কর্পোরেট দুনিয়ার জমকালো জীবনধারণ, মোটা মানিব্যাগের কচকচানিতে বড় জোর সময় কাটাতে যাওয়া যেতে পারে আপনাকে দেখতে কিন্তু যারা আপনাকে চেনে না তারা কেউ যাবে না কোন বাল বাংলা খেয়ে মাতলামো করত, বয়ে গেল তাঁকে দেখতে যেতে কিন্তু বিষয়টা অন্য আপনার ছবিতে যে দেশভাগের যন্ত্রণা আমাদের আবেগকে অনুভূতিতে সঞ্চারিত করে, সেই আবেগ কমলেস্বর বাবুর ছবিতে ফুটে ওঠে না খাপছাড়া ভাবে আসে আপনার ছবির অংশবিশেষ যা আমরা বহুকাল ধরে দেখে আসছি নতুন ভাবে দৃশ্যত এই অংশ আমার আবেগকে ছোঁয় না



বেশ করেছিলেন পাগলামো করেছিলেন, যে সময় চলছিল তখন আপনার মতন মানুষ আজকের বাঞ্চতদের মতো নাকে তেল দিয়ে ঘুমাতে পারত না একের একের পর এক কিশোরকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার নামে গুলি করে খুন করা হচ্ছিল আর কিছু মানুষ এসবের ফায়দা লুটে নিজেদের আখের গোচ্ছাচ্ছিল কে বলেছিল গান্ডুদের বিদ্রোহে করতে? কী হয়েছিল এর ফলে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন ছেড়ে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ ছেড়ে সমাজ বদলাবার দায় নিয়েছিল বাল ছিঁড়েছিল আত্মবলিদান কেউ মনে রাখেনি, আর রাখবেও না ওরা নকশালই রয়ে গেল তাই আজকের দিনে এসে বিনায়ক সেনের হাজতবাস বা কিসেনজীর মৃত্যু রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিষয় হয়ে যায় আপনার কথাই ঠিক রাষ্ট্র থাকলে রাষ্ট্র দ্রোহিতাও থাকবে কিন্তু কি জানেন ছবিতে এই আত্ম বলিদানের পিরিয়ডটা কেমন যেন নিঃসার কোন আগুনের ঝলকানো নেই বিদ্রোহে ফুঁসে ওঠা নেই, সময়কে ডাক দিয়ে সময় বদলানোর বাসনা শুধু গুলি করে মৃত্যু দেখি আর দেখি অজ্ঞাতবাসরে আপনিও কীভাবে মিশে যান ওদের সাথে আজ আমরা স্ট্যাটিস্টিক মেলাই, গত বছরের তুলনায় কজন বেশী ধর্ষণ হোল আর কটা মাওবাদী মারা গেল আর দেখি আমাদের রাজ্য এবারে এসবের বিচারে শীর্ষস্থান অধিকার করেছে আজ বলতে ভয় লাগেকটা বাঙালি আপ দেখা হ্যায়সব বাঙালিই হয় কর্পোরেট ঢ্যামনা, নয় ধর্ষণকারী বাঞ্চত আর আমরা হলাম তৃতীয় শ্রেণী, দুটোর কোনটাই সাপোর্ট করি না, শুধু মুখ বুজে সহ্য করে যাই একটু বেশি পদক্ষেপ নিলেই আবার রাষ্ট্রের চোখ রাঙানি





আপনাকে কেন্দ্র করে আপনার চারপাশের সব চরিত্ররা সবাই ছিলেন, কিন্তু তারা চরিত্রই রয়ে গেলেন, চরিত্রের বাইরে এসে রক্তমাংসের আসল মানুষটা হতে পারলেননা নতুন আর কিছু বলার নেই জানেন, পয়সা পেয়েছিলেন তাই সেট, আর্ট, ক্যামেরা এসব তো ভালো হবেই কিন্তু এসবকে আলাদা ভাবে চেনা যায় একটা সেট চরিত্রদের থেকে বেরিয়ে এসে নিজে একটা চরিত্র হয়ে উঠতে পারে না একটা দৃশ্যের আর্ট ডিরেকসন আমায় কোন সময়ের কথা মনে করায় না কেমন মোনোটোনাস আর সঙ্গীত, মুহূর্তে আবেগ সৃষ্টি করে না, রাগে বিদ্রোহের প্রকাশ ঘটায় না বেজে চলে শুধু দৃশ্য থেকে দৃশ্যের পর লোক সঙ্গীতের ব্যাবহারও, শুধুমাত্র ব্যাবহার করার জন্যই থেকে গেল মানুষের জীবন দর্শন হয়ে উঠল না তা



আর কী বলি বলুন তো সময়টা কেমন স্থির হয়ে আছে মেঘ করেছে বুঝতে এই বুঝি বৃষ্টি নামবে নামুক, কিছু এসে যাবে না তাতে আর কেউ স্পর্ধা দেখানোর সাহস করবে না আমরা গুটিয়ে যাব ধীরে ধীরে আপনি থাকুন যেখানে আছেন যেমন তবে আপনাকে মনে করিয়ে দিই এই হাড়হাভাতে সময় যখন বাংলা ছবি বলতেই মানুষ কোমর দুলিয়ে বিদেশি নাচের কথা ভাবত এমন একটা সময়ে কমলেস্বরবাবু একটু অন্য ভেবেছেন তাই তাঁকে কুর্ণিশ



আমরা কেউ উদ্বাস্তু দেখেনি ঋত্বিক বাবু এপারে জন্মেছি শুনেছি, পড়েছি সেই সময়ের কথা, কেমনভাবে মানুষ ঘরছাড়া হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছিল সর্বস্বান্ত হয়ে সেই সময়ের বেদনা যেভাবে আপনার ছবিতে উঠে এসেছিল, এবারে আপনি পর্দায় উপস্থিত থেকেও সেই বেদনাকে স্পর্শ করাতে পারলেন না আমায় আমরা আপনার ভূমিকায় শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের ভালো অভিনয় দেখি, আমরা আপনাকে নির্মাণের ভূমিকায় কমলেস্বর মুখোপাধ্যায়ের ছবি দেখি, কিন্তু সারা ছবি জুড়ে আপনাকে দেখি না দেখি না সেই মানুষটাকে যে সগর্বে বলতে পারেসিনেমার জগতটা আদ্যোপান্ত শুয়োরের বাচ্চায় ভরে গেছেমাফ করবেন আপনার থেকে খানিকটা স্পর্ধা রপ্ত হয়েছে, তাই সামান্য জ্ঞানের ঝুলি নিয়ে এর চেয়ে ভালো ভাষায় আর লিখতে পারলাম না যাই হোক ভালো থাকবেন প্রণাম নেবেন





                                                  ইতি



      অন্ধকার গলিতে হারিয়ে যাওয়া, সমঝোতা করতে না পারা এক বঞ্চিত বাঞ্চত


লেখাঃ আদিত্য।
ছবিঃ ওয়েব।           

২টি মন্তব্য: