শুক্রবার, ৩১ মে, ২০১৩

সব চরিত্র কাল্পনিক নয়।


সকালটা এমন অন্ধকার ছিল না , প্রিয় স্যার এর সাথে বৃষ্টি নিয়ে মজা করছিলাম। এর মধ্যে বান্ধবীর টেক্সট “ ঋতুপর্ণ ঘোষ আর নেই? কি হয়েছিল তুই জানিস?” আকাশ যে সেই যে অন্ধকার হতে শুরু করল আর আলো ফুটল না। তারপর অগুনতি টেক্সট এলো দুপুর পর্যন্ত সাপ্তাহিক পত্রিকার এন্টারটেনমেন্ট বিট সামলানো বান্ধবী থেকে ফিল্ম স্টাডিজ পড়া বন্ধু পর্যন্ত সবার একটা প্রশ্ন “এতো তাড়া কিসের?” প্রিয় স্যারকে আবার ফোন করি খবরের সত্যতা জানতে। তারপর আর উত্তর দিতে পারিনি কাউকে। “তুই কি একটা লেখা দিতে পারবি? / একটা পোস্টার বানা আজ ওনার জন্য / ঋতুপর্ণের কোনও ছবির রিভিউ কি তোদের ব্লগ এ আছে? / মৌন,  দহন আর চোখের বালি নিয়ে একটা কপি লিখে দিতে পারবি এ সপ্তাহে?” কাউকে উত্তর দেওয়া হয় নি। মনে ভিড় করে আসে অনেক কথার মেঘ। অফিসের জানলার বাইরে তখন মুষল ধারাতে বৃষ্টি নয় কান্না। ফিরে গেলাম ২০০৩ এর “চোখের বালি”তে।






 আমি স্কুলে পড়ি কেবল মাত্র শরৎচন্দ্র , রবীন্দ্রনাথ পড়া শুরু করেছি। “চরিত্রহীন” ও “চোখের বালি” পড়ে ফেলেছি।  আমার ছোট্ট মফস্বল তখন গ্রাম। দুটো মাত্র সিনেমা হল সেখানে সব সময় প্রসেনজিত , ঋতুপর্ণার ধিসুম ধাসুম চলে। তখনো সিনেমা আমাদের কাছে “বই”। আমার স্কুলের সামনে বাস স্টপের দেওয়ালে পোস্টার পড়েছিল “ চোখের বালি” বাঙালি বধুর সাজে ঐশ্বর্য রাই। প্রথম বার দেখলাম কোনও নারী কেন্দ্রিক ছবি । ‘বিনোদিনী আর আশালতা”। প্রথম বার বড়দের সিনেমা পত্রিকা “ আনন্দলোক” এ দেখলাম সম্পাদক-পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ কে। মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল , আর গোল ফ্রেম এর চশমার ওপারে ভীষণ গভীর দুটো চোখ।

ধীরে ধীরে আমার স্কুল শেষ হল । ক্রমশ ঝুকে পড়লাম পরিচালকের ছবির দিকে। শুরু হল শেকড়ের সন্ধান । কোনও এক রবি বারের দুপুরে প্রথম বার টিভি তে “উনিশে এপ্রিল” কিছুটা বুঝেছিলাম কিছুটা বুঝিনি।  সম্পর্কের কথা ঠিক কিভাবে বলতে হয়। সম্পর্ক আসলে কি?

তারপর একদিন দেখলাম “দহন” মনে আছে হাউ হাউ করে কেদেছিলাম রমিতা আর ঝিনুকের নাছোড় বাধা জেদ দেখে। প্রথম বার নিজের ওপর রাগ হয়েছিলো। প্রথমবার কলেজ যাওয়ার পথে স্টেশনে বসে থাকা ইভটিজার দেখলেই “দহন” ছবির কথা মনে পড়ত।  যা আজও ভুলতে দিলনা । ঋতুপর্ণ ঘোষ ততদিনে রেনকোট , দোসর করে ফেলেছেন। দু একটা পত্র পত্রিকা তখন খোলা খুলি তার সেক্সুয়াল আইডেন্টিটি নিয়ে লিখতে শুরু করেছে।

তখনও জানিনা সিনেমা আমাকে এভাবে ঘর ছাড়া করে তুলবে , ধীরে ধীরে সিনেমার নিশিডাক আমাকে পেয়ে বসেছে । ট্রেন ধরে শহরে এসে নন্দন বা নিউএম্পিয়ার এর সস্তার ব্যাল্কনির সাথে ততদিনে বেশ পরিচয় হয়েছে।  তখন একটা ছবি করলেন “সব চরিত্র কাল্পনিক” এক কবি কেন্দ্রিক ছবি । ইন্দ্রনীল মিত্র আপন ভোলা কবি, নিজের সৃষ্টি তে ডুবে থাকেন । তাকে কেউ সেভাবে বুঝতে পারে না। হটাৎ একদিন ঘুমের মধ্যে মারা যান কবি ইন্দ্রনীল। তারপর কবি-স্ত্রী বুঝতে পারেন , ইন্দ্রনীলের গভীরতা । আসেপাসের মানুষগুলো বুঝতে পারে একা থাকা কবি ইন্দ্রনীল আসলে কি বিরাট সৃষ্টির আধার ছিলেন। গতকাল সকালে আমার বার বার মনে হচ্ছিলো এই ছবির কথা। আমরা কি কেউ বুজতে পেরেছিলাম?

সিনেমা দেখা এবং সেটা নিয়ে আলোচনা করার আদিখ্যেতা ধীরে ধীরে আমার একটা ঔদ্ধত্যে পরিণত হচ্ছিল। যদি কোনও ছবি দেখে খারাপ লাগে সেটা নিয়ে উত্তেজিত হয়ে লেখাটা অভ্যেস হয়ে উঠছিল। “চিত্রাঙ্গদা” দেখে স্তম্ভিত হয়ে  গেছিলাম , ছবিটা আমার খুব পছন্দ নয়। আর একটা কষ্টের নাম “চিত্রাঙ্গদা”। তীব্র অভিমান হয়েছিলো। মনে হত এটা আসলে ঋতুপর্ণের প্রতিবাদের ছবি হতে পারত, আরও তীব্র হতে পারত এর ট্রিটমেন্ট । এই ছবিটা হিপক্রিট বাঙালির মুখোশ খুলে দিতে পারত । যাতে যৌনতা নিয়ে বাঙালি আর কখনো ন্যাকামি না করে। যাতে বাস ট্রেনে আর কাউকে সুনতে না হয় “ঋতুর” মত। কিন্তু এতো সব সম্ভবনা কে কি পেরিয়ে যেতে পেরেছিল  “চিত্রাঙ্গদা”? । এটা নিয়ে তুমুল ঝগড়া হয়েছিলো বন্ধুদের সাথে , প্রিয় শিক্ষকের সাথে। জেদি আমি সেদিন আমার জেদ ছেড়ে কিচ্ছু বুঝতে চাইনি।

আজ সব জেদ , অভিমান, ঔদ্ধত্য কিভাবে যেন শোক আর অশৌচ হয়ে নামছে আমার কলম বেয়ে। আর কোনও ছবি নিয়ে অভিমান হবে না। আর কোনও ছবির রিভিউ লিখে ক্ষোভে ডিলিট বাটন টিপে দেবো না। এপাশে রয়েগেলাম আমাদের মত অবুঝ শৈশব না শেষ হওয়া কিছু সিনেমার ছাত্র আর ওপারে চলে গেলেন শেষ কোমল-কঠিন অবয়ব এর ক্লাসি পরিচালক “ ঋতুপর্ণ ঘোষ”।

সেদিন যাদের সাথে জোর ঝগড়া হয়েছিলো সেই বন্ধুদের , আর “স্যার” তোমার ভীষণ যত্নের “ব্যোমকেশ” আর “অজিত” কে দিয়ে গেলেন আমাদের। আসলে “সত্যান্বেষী” নয় তিনি শেষ নিঃশ্বাস টুকু দিয়ে গেলেন সিনেমাকে।
   
অবুঝ শৈশব না শেষ হওয়া কিছু সিনেমার ছাত্রের প্রণাম। 



লেখাঃ মৌন 
সহায়তা ঃ আদিত্য ও ঊষশী   
পোস্টারঃ অঙ্কন ও মৌন।



২টি মন্তব্য: