মঙ্গলবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

মধ্যরাতের শিশুদের ম্যাজিকের মোহভঙ্গ



সেলিব্রিটিদের প্রধান বৈশিষ্ট্য যদি বলা হয় তাহলে প্রথমেই আসে যে তারা সবসময় বিতর্কে থাকতে পছন্দ করে। বিতর্কই তাদের লাইমলাইটে তলায় এনে দার করায়। কিন্তু যে বিতর্কের আগুন বহুদিন ধরে চলছে, যে বিতর্ক সরকার পাল্টালেও বদলাও না। সেকি শুধুই কিছু উগ্র মৌলবাদীদের ঔদ্ধত্য ফলানোর জন্য না এর পিছনেও গভীর রাজনৈতিক চাল আছে। সেসব অতীব চালাক ব্যক্তির পক্ষ্যেও সহজে বোঝা সম্ভব নয়। আমাদের মত মুর্খের পক্ষে তো নইই। কেননা আমরা তো গণতন্ত্র বুঝতে শুধুমাত্র ভোটদান পর্বকেই বুঝি। থাক সেসব জটিল আলোচনায় গিয়ে লাভ নেই। মুল আলোচনায় ফিরে আসাই ভাল। কিন্তু এসব ভাবার একমাত্র কারন হল বঞ্চনা। কেন আমরা সাধারন মানুষ বারবার কিছু নিষ্ঠুর অসামাজিক দায়বদ্ধহীন মানুষের জন্য বঞ্চনার স্বীকার হব। কেন ২০০৭ সালের নভেম্বরে বিদেশী লেখিকাকে রাজ্যহীন করা হবে, কেন একজন সাধারন মানুষ সেই দিনে আর্মিদের অজস্র প্রশ্নের উত্তর দেবে, কেন সর্বদা একটা ভয় নিয়ে সেদিন কোথাও যেতে হবে, শুধুমাত্র সে প্রতিষ্ঠান বিরোধী লিখেছে বলে? এ প্রশ্নের কোন উত্তর হয় না কারন সেই ট্র্যাডিশন আজও ক্রমবর্তমান। শুধু একরাশ কালো অন্ধকার আমাদের গ্রাস করে নেয়। ইচ্ছে গুলোকে নেতিয়ে দেয়, স্বপ্নকে দুঃস্বপ্নে পরিনত করে।
অনেক আগেই শুনেছিলাম যে এবারের বইমেলায় সাহিত্য আলোচনা সভার মূল বিষয় “ছবি”। সিনেমার ছাত্র হিসাবে তাই খানিক আগ্রহই বেড়ে গিয়েছিল। আরও বাড়ল যখন সলমন রুশদি তার উপন্যাসের চলচ্চিত্রকরন নিয়ে আলোচনা করতে আসবেন পরিচালক দীপা মেহেতাকে সঙ্গে নিয়ে। কিন্তু হল না। রাজ্যে তাকে প্রবেশ করতে দেওয়া হল না। সরকারি ভোট ব্যাঙ্ক বহাল তবিয়তেই রইল। শুধু আলোচনা সভাটাই ভেস্তে গেল। তাই খানিক বিমর্ষ হয়েই চলে গেলাম “ মিডনাইটস চিলড্রেন” দেখতে। পকেটে টাকার অভাব এ যাত্রায় খানিক বাচল খয়েরি মানিব্যাগের সৌজন্যে।
গোটা ছয় মানুষ সারা সিনেমাহল জুড়ে। আমরাই মনে হয় একমাত্র যারা সিনেমাটাই সত্যি দেখতে এসেছি। পপকর্ন খেতে বা গলা জড়িয়ে বান্ধবীর সাথে গল্প করতে নয়। উপন্যাস পড়ার সৌভাগ্য হয় নি। এমনিতেই ভীতু তার ওপর আবার ৬০০ পাতার গভীর একটা ইংরাজি উপন্যাস। সে যাই হোক ৬০০ পাতা না হয় না পড়লাম কিন্তু ১৩০ পাতার চিত্রনাট্যের চিত্ররূপ দেখলাম। যেহেতু প্রেক্ষাপট স্বাধীনতার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ভারতীয় সমাজ। তাই সহজ ভাবেই বলা যেতে পারে যে ছবির দৃশ্য গ্রহণ পুরোটাই ভারতে গৃহীত হবে। কিন্তু মৌলবাদী চিন্তাবিদদের আক্রমণের প্রভাবে ও উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের অমসৃণ আচরনের ফলে ছবির অধিকাংশ দৃশ্য গৃহীত হয়েছে শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে, উইন্ডস অফ চেঞ্জ ছদ্মনাম দিয়ে। তাও ছবির দৃশ্য গ্রহণ বন্ধ ছিল যখন ইরান শ্রীলঙ্কার সরকারের কাছে ছবির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। পরে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট এর হস্তক্ষেপে ছবির দৃশ্য গ্রহণ আবার পুনরায় শুরু হয়।
সলমন রুশদি এখানে ছবির বিবরক। তার গলায় তার ভাষায় তার শব্দে আমরা গল্প শুনি। ছবির চিত্রনাট্য ও তার লেখা। এখানেই আসল মুশকিলটা হয়ে গেছে। রুশদি নিজে তার ৬০০ পাতার উপন্যাসকে ২ ঘণ্টা ২৮ মিনিটের পর্দায় চিত্রায়িত করার সময় তিনি ছবির কোন ঘটনাকে প্রাধান্য দেবেন আর কোন ঘটনাকে সুক্ষ ভাবে এরিয়ে যাবেন তিনি বুঝতে পারেন নি। লেখক-চিত্রনাট্যকেরের মধ্যে এটাই সমস্যা যে তিনি একবারও তার গল্প থেকে বেরোতে পারেন না। চিত্রনাট্যও তাই এক্ষেত্রে গাল্পিক হয়ে গেছে। সাহিত্যাকারে গল্প আমরা পর্দায় দেখি। সিনেমার ভাষা আর সাহিত্যের ভাষা কে এক্ষেত্রে আলাদা করা যায় না। তাই প্রায় ৪৫ মিনিট লাগে পরিচালকের ছবির সব চরিত্রকে স্বকীয় ভাবে স্থাপন করতে।
ছবির একটা বড় অলঙ্কার হল সময়। ১৯১৭ থেকে ১৯৭৭ সাল অবধি সময়কে এখানে ধরা হয়েছে। এই সময়ের ব্যাবধানে যা যা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে সবই ছবির এক একটা অঙ্ক। স্বাধীনতা, পাকিস্থানের গৃহযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ, এমারজেন্সি ইত্যাদি সব। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলি আমার মনকে ছুঁয়ে যায় নি। আমি স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে জাতীয় সঙ্গীতের সময় উঠে দাড়িয়ে বীরত্বে বুক ফুলিয়ে উঠিনা। জয় বাংলা স্লোগান আমায় উজ্জিবিত করে না। করবেও না। কারন ছবির যে অংশে এসে মুক্তিযুদ্ধ আসে বা এমারজেন্সি সেই সময়টার পর্দার উপরিস্থ দৃশ্য বড় প্রাণহীন। মৃত ব্যক্তির দেহ সবুজ বাংলার মাঠে শুইয়ে দিলেই আর মুজিবর রহমানের ছবি দিলেই কি প্রাণহীন ওই দেহ গুলির ওপর ভার্চুয়াল প্রাণের সঞ্চার হয়। যেমন ছবির চরিত্র গুলোর মধ্যেও প্রাণের বড় সমস্যা। কে প্রাধান্য পাবে আর কে না সেটা বোধহয় পরিচালক গুলিয়ে ফেলেছেন। তাই মূল প্রটাগোনিস্ট নিজের মুখেই কখনও বলে ওঠে তার ঠাকুরদা ঠাকুরমার প্রেম কাহিনী। যে গুলো নিছক অবাঞ্ছনীয়। কোন প্রয়োজন ছিল না ছবির সাথে তাল মিলিয়ে এই অংশকে পর্দাস্থিত করার। বরং যেটা বেশি প্রয়োজন ছিল সেটা হল ছবির প্রাণ ভোমরা যেখানে লুকিয়ে আছে সেই ম্যাজিক রিয়ালিজম এর অংশকে।
সেলিম ১৪ই আগস্ট, ১৯৪৭এ রাত ১২ টা বেজে জন্ম নেয়। বড় হওয়ার সাথে সে নতুন এক দিকের কথা জানতে পারে। নাকের সর্দি যখন টানে তখনই তার সামনে সেই সব চরিত্ররা এসে হাজির হয় যারাও সেই মধ্যরাতে জন্ম নিয়েছিল। তারা আলোচনায় বসে, কনফারেন্স করে, নতুন ভাবে সমাজকে সাজানোর স্বপ্ন দেখে। কিন্তু পরক্ষনেই সেই স্বপ্ন হারিয়ে যায় আর ছবি তত গতিহীন হয়ে যখন এই ম্যাজিক চরিত্রগুলি বাস্তবে ফিরে আসে, আবার আবরা-কা-ডাবরা বলে জ্যান্ত মানুষকে ভ্যানিস করে সীমান্তের বেড়াজাল টপকায়। যেখানে স্থান পায় ব্ল্যাক ম্যাজিক, পরকীয়া প্রেম আর তদুপরি সমসাময়িক রাজনীতি। যে রাজনীতির স্বীকার এই মধ্যরাতের শিশুরাও, সুস্থ সময় ফিরিয়ে আনার তাগিদে তাদেরও  জেলবন্দী করা হয়। কিন্তু যার আদেশে যে করে সেও তো ওই মধ্যরাতেই জন্ম নিয়েছিল, তাহলে সে পার পেয়ে যায় কি করে? যে বন্দীকরন আসলে সাম্প্রদায়িক পরস্থিতিকে কটাক্ষ করার জন্য লেখা হয়েছিল সেই বন্দীকরন ছবির এই পর্যায়ে এসে খাপ খায় না। মেনে নেওয়া যায় না ম্যাজিক এর গল্প বাস্তবে ফিরে এসে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়।
ম্যাজিক রিয়ালিজম, আসলে ম্যাজিকের আঙ্গিকে বাস্তব পরিস্থিতিকে কটাক্ষ করা। যেমন ফারনান্দো সোলানাস তার জার্নি ছবিতে তুলে ধরেছেন। কমিক বইয়ের চরিত্ররা বাস্তবে এসেও তাদের কমিক আঙ্গিকটা ঠিক ধরে রেখেছিলেন। বাস্তবে এসেও তারা ম্যাজিকের চরিত্রর মতনই ছিল। আলাদা ভাবে বাস্তবে মিশে যাই নি। বরঞ্চ সুকৌশলে তারা বাস্তব পরিস্থিতিকে কটাক্ষ করেছেন। এখানে পার্বতী বা অন্য কেউ কোন ভাবেই পারে নি। তারা বাস্তবেও বড়ই অমসৃণ হয়ে আছে। সেলিমের জার্নি আর সোলানাসের জার্নি তাই বিষয়গত ভাবে ম্যাজিক রিয়ালিজমের ওপর ভিত্তি করে চললেও কখনই সমান্তরাল ভাবে এগোতে পারে নি একে ওপরের সাথে। ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে।
চরিত্রদের মধ্যের দ্বন্দ্ব, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে তাদের উদ্বেগ এসবও ছবিতে থাকে না। আসলে দুর্বল চিত্রনাট্যে চরিত্ররা প্রাণ পায় না। সঙ্গীত দিয়েও তাদের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করা যায় না। ছবির সঙ্গীতও বড়ই দুর্বল তাই। দৃশ্যকে দর্শকের মনে গেঁথে নেওয়ার ক্ষেত্রে সঙ্গীত কোন ভাবেই সাহায্য করতে পারে না।
পরিশেষে বলতেই হয় যে এক ঝাক অভিনেতা অভিনেত্রীদের দুরন্ত অভিনয়, পরিচালকের সহজাত বুদ্ধিমত্তা সত্ত্বেও “মিডনাইটস চিলড্রেন” মধ্যরাত্রির গগনে ধ্রুবতারা হয়ে দিক দেখাতে অক্ষম। যে ম্যাজিক উপন্যাসে স্থান পেয়ে ৩৩ বছর আগে রুশদিকে বুকার পুরস্কার এনে দিয়েছিল সেই ম্যাজিক দীপা মেহেতার হাত দিয়ে আজকের বাস্তবে এসে ম্যাজিকের রূপ নেয় না। বড়ই সোজা সাপটা ভাবে একটা বড় সময়কে পর্দায় ধরা ছাড়া আর কিছুই করতে সক্ষম হয় না।

ছবিঃ  মিডনাইটস চিলড্রেন।
পরিচালকঃ  দীপা মেহেতা।
প্রযোজনায়ঃ  ডেভিড হ্যাম্লিন্টন, ডগ ম্যাঙ্কফ, স্টিভেন সিলভার, নেইল টাবাজনিক প্রমুখ।
অভিনয়ঃ  সত্য ভব, শ্রেয়া সরেন, সিদ্ধার্থ, সাবানা আজমি, রজত কাপুর, অনুপম খের, রাহুল বোস, সাহানা গোস্বামী, দর্সিল সাফারি প্রমুখ।


1 টি মন্তব্য: