বুধবার, ১ জুলাই, ২০১৫


“রোগা হওয়ার সহজ উপায়”

ফ্রায়েড রাইস , চিলি চিকেন আর চাকরি চলে যাবে এমন অবস্থার মাঝের সময় চুলের ডি এন এ টেস্ট আর খাবারের প্রেমে পড়তে গিয়ে সুন্দরী প্রেমিকা জুটে যাবার অঘটনের নাম “রোগা হওয়ার সহজ উপায়” । কবে থেকে শুনে এসেছি পেট রোগা বাঙ্গালির খাবারের প্রতি আসক্তির কথা, মধ্যপ্রদেশ এর মাপ যখন ম্যাপের বাইরে তখনও প্রানের মানুষের মুখ ঝামটানি শুনেও হাসিমুখে ডাবল ডিমের চিকেন রোল নিয়ে দুজনে রেলিং এ পা দোলাতে দোলাতে খাওয়ার যে স্বর্গীয় অনুভূতি পেট রোগারা তাঁর কি বুঝবে?


সেই নাক কোঁচকানো , ওয়াক্সিং করা সরু কোমরের নারী পুরুষ জাতির প্রতি পরিচালক দেবালয় ভট্টাচার্য’র প্রশ্ন “পৃথিবীর ইতিহাস আসলে কার ইতিহাস?”। একা থাকা সুন্দরী নারী ফোন করে হোম ডেলিভারি তে খাবারের অর্ডার করতে চান, ভুল করে বার বার ফোনটা ‘বাল(চুল)’ কেলেঙ্কারি তে চাকরি হারাতে চলা শেফ এর কাছে এসে পড়ে। তাঁর পর সিনেমার নিয়ম মেনেই খাবার পৌঁছে দেওয়া, ঘনিষ্ঠতা ও প্রেমএ পর্যন্ত কোনও দুষ্টুমি নেই।যা দুষ্টুমি করার সেটুকু অভিনেতারা কেউ করেন নি। পরিচালকের লেখা ডায়লগ ঠিক দুষ্টু নয়, বরং সরু কোমরের প্রেমিকার তীক্ষ্ণ উচ্চারণে “নটি” বলা যায়। এর পর বেগুন ক্ষেতে প্রেম নিবেদন ......... অদ্ভুত তো ‘হুম’ করার কিছু হয়নি , সুস্বাদু খাবার নিয়ে যার কাজ, তাঁর জীবনে বাঙালির অতি প্রিয় লম্বা ঝোলা বেগুনি রঙের বেগুন না থাকলে কিকরে জমবে শুনি?



 বিয়ের পর বন্ধুবান্ধব , পাড়া পড়সির ছোট্ট ছোট্ট চিমটি “রোগা হ্যান্ডসাম ছেলের কিনা মোটা ধ্যাবড়া মার্কা বউ?” এই চিমটি গুলো নিমেষে দুজনের হাবুডুবু পায়ে পা দিয়ে সুড়সুড়ি দেওয়া প্রেমের ভিলেন হয়ে দাঁড়ালো ? এক নিমেষে প্রেম কিনা মনের ডাক্তার ঘুরে অভিমানী পথে ধরে , থলে-থলে কোয়ানটিটি মাপা বাটুলের প্রেমিকার কাছে? সেই লাস্যময়ির ইশারা ইঙ্গিত এবং কথাতে আশ্বস্ত হয়ে দু সপ্তাহের ক্রাশ কোর্স “ বউ রোগা হয়ে ছিপ ছিপে তন্বী হবেন”। এ পর্বের কথার দুষ্টুমি প্রায় ট্যাংগোর মত সুস্বাদু। আচমকা হোটেলের বসের তলবে সেফ স্বামীকে দু সপ্তাহের জন্য বিদেশ যেতে হয়।



ফিরে এসে অন্য ঝামেলা বউ তো না হয় রোগা হয়ে এফ টিভি মডেল হয়ে এলো কিন্তু এ নারী আসলে সেফের আদরের ‘রঞ্জু’ তো? নাহ সন্দেহ কিছুতেই কাটে না, এই সুন্দরী যতয় সংসার করুক না কেন এ সেই মানুষ টা নয়। তাহলে কোথায় গেল জোর করে রোগা করে দিতে চাওয়া নিজের আদরের ‘রঞ্জনা’। এবার সেফ এর ভূমিকাতে অভিনয় করা পরমব্রত কে খুজতে বেরোতে হয় তাঁর একান্ত প্রিয় , একান্ত আপন রঞ্জু “ রাইমা” কে। এরপর? সে অংশ কিছু আর থল-থলে , কল-কলে দাঁত কেলানো গল্প নয়বরং প্রেম হারানোর যন্ত্রণাবিদ্ধ মানুষের প্রেম খুঁজে পাবার গল্প। এই অংশটা বরং সিনেমার জন্য তোলা থাক। ওটা সিনেমার পর্দাতেই মানায়।    


বরং কথা হতে পারে চিকেন স্ট্রিপটিস এক্সপেরিমেন্টাল নামক ডিশ নিয়ে,  সিঙ্গাপুরি কলা নিয়ে, ম্যাসেজ করাতে করাতে জাপান আবিষ্কার নিয়ে, “নুন ছাড়া খাবারের মত ভালোবাসি” নিয়ে, ঋ লেখা টি শার্ট পরা মোটা লোকেটা গোপন মন্ত্রবলে রোগা সুন্দর “সুরেশ” হয়ে যাওয়া নিয়ে, এমনকি প্লাস্টিকের হাত দিয়ে লাস্যময়ীর পিঠ চুলকানো নিয়েও। মোদ্দা কথা ছবির ভাষা নিয়ে খেলার পর্যায়টা সত্যি অন্যরকম। দেবালয় ভট্টাচার্য’র ছবির ভাষা আগামী দিনের সিনেমার ভাষা কি না? এ ছবির বক্স অফিস কি হবে? এসব প্রশ্ন কে পাশে সরিয়ে রেখে বরং ইলিশের মরসুমে এছবিকে উপভোগ করবার হলে গিয়ে দেখা যেতে পারে।

আসলে রোগা বা মোটা নয় পৃথিবীর ইতিহাস তো মানুষের ভালোবাসার ইতিহাস, এই ভালোবাসার তীব্রতা সুন্দর করে দিতে পারে সম্পর্ক, বেঁচে থাকার মুল কথা একটা নির্ভেজাল প্রেম ,সাইজ দাজ নট ম্যাটার কান খুলে শুনে নাও স্লিম বালক বালিকারা। আর দ্বিতীয় এবং সমান গুরুত্বপূর্ণ কারন “জিভে জল আনা সুস্বাদু খাবার”. খাও এবং খাওয়াও আর প্রেমে পড়, জীবন খুলে বাঁচো। জয় ঝালে, ঝোলে, অম্বলে, ভালোবাসা- প্রেমে বেঁচে থাকা প্রজন্মের জয়।
যেখানে খাবারের গন্ধ আছে সেখানে ক্যামেরা , লাইট , সাউন্ড, ডিরেকসন অমুক তমুক নিয়ে কথা বলে সময় নষ্ট করার থেকে খাবারের প্রতি মন না দিলে যে পাপ হবে, তাই এই পর্বটা আজ তোলা থাক।  



লেখা: মৌন।

রবিবার, ১৫ জুন, ২০১৪

ফিল্মিস্থানঃ একটা দেশ ভাগের গল্প

সিনেমা একটা নিশি ডাক, যে ডাকে ঘর ভাঙে, দেশ ভাঙে। সিনেমা করে বেঁচে থাকতে গিয়ে মুখে রক্ত উঠে যায়, তবু নেশাটা সঞ্চারন হয় আগামী প্রজন্মে। সানি তো সেরকম একজন মানুষ যে সিনেমার সাথে থাকতে চায়, হতে চায় একজন অভিনেতা, অডিশনের পর অডিশন এবং ব্যর্থতা। এসবের মাঝেই এক বিদেশী সিনেমা দলের সাথে কাজ করার সুযোগ মিলে যায়। রাজস্থানে শুটিং হবে। সানি এই দলটার অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর এবং প্রোডাকসান বয় বটে। এভাবেই খুব রঙিন ফ্রেম জুড়ে শুরু হয়েছিল  নিতিন কক্কড় পরিচালিত ছবি "ফিল্মিস্থান"। 


এই দলটির সাথে সানি রাজস্থানে পৌঁছে শুটিং শুরু করে এবং এক রাতে তাকে অপহরণ করা হয় এবং বালির পথ বেয়ে সে পৌঁছে যায় এক দেশ থেকে আরেক দেশে। যে দেশটার নাম পাকিস্তান। এখানে সানি কে আটকে রাখা হয়। সেই বন্দি ঘরে তাঁর একমাত্র সঙ্গী বলিউড। হিন্দি সিনেমার গান, হিন্দি সিনেমার ডায়ালগ।এসবের মাঝেই তার সাথে দেখা হয়ে যায় আর এক সিনেমা পাগলের। আফতাবের। পাকিস্তানি কিন্তু পেট চালানোর জন্য সে ভারতীয় হিন্দি ছবির পাইরেটেড সিডি, ডিভিডি বিক্রি করে। 

দেশভাগটা কি খুব জরুরি? এরকম একটা রক্ত ঠাণ্ডা করে দেওয়া প্রশ্ন চুপিসাড়ে মাল্টিপ্লেক্সের ঠাণ্ডা ঘরে আপনার পাসের সীটে এসে আপনাকে প্রশ্ন করবে আর তখন থেকে আপনার গরম লাগা শুরু হবে। যে মুহূর্তে উগ্রপন্থীদের কাছে বিস্ময় প্রকাশ করবে সানি যে সে কিভাবে পাসপোর্ট ছাড়া বিদেশে চলে এলো বা পাকিস্তানি মরুভুমি অঞ্চলের বাচ্চাদের সাথে সে হিন্দি সিনেমার অঙ্গভঙ্গি করে দেখাবে তখন একবারও মনে হবে না যে একটা মানুষ কোথাও গিয়ে সীমানা পেরিয়ে অন্য দেশে আছেন।
দর্শকদের রক্তে তখন একটা অস্বস্তি শুরু হবে স্বাভাবিক ভাবেই উঠে আসবে একটা প্রশ্ন কেন এই দেশভাগ? কেন এত যুদ্ধ। দুটো দেশ একরকম পোশাক পরে, একরকম খাবার খায়, একি আকাশ দেখে। এই সাধারন গরিব মানুষ তো দেশ ভাগ চায়নি। এখান থেকে এই ফিল্মিস্থান আর হাসির ছবি থাকে না। ধীরে ধীরে হাসি মজা হরবোলার মোড়কে দেশভাগকারি মহান রাজনীতিবিদদের ( হ্যা দেশপ্রেমিক নয় ক্ষমতা লোভী রাজনীতিবিদ) প্রতি মোক্ষম প্রশ্ন ওঠা শুরু হয়। 

ধীরে ধীরে ওদিকে সানির সাথে আফতাবের বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হতে থাকে। সানি তাঁর মিষ্টি স্বভাবের জন্য গ্রামের সাধারন মানুষের কাছে আরও প্রিয় হয়ে ওঠে। এই সিনেমাপাগল ছেলেটার কাছে সিনেমা মানে তো সব কিছু। সে অভিমান হলে ফিল্মি ডায়ালগ বলে, তাঁর বেলল্লেপানার শাস্তি হিসেবে উগ্রপন্থীরা প্রচণ্ড মারতে থাকলে সে সিনেমার মত করে বলে "মর্দ কো কাভি দরদ্ নেহি হোতা"।
 সে ম্যায়নে পেয়ার কিয়া ছবির গান শুনে বন্দি থাকা ঘরের মধ্যে  নাচতে থাকে এবং একের পর এক ডায়ালগ বলতে থাকে। তাঁর এই সিনেমাপ্রেম একটা সময় উগ্রপন্থীদেরকে কিছুটা উদার হতে বাধ্য করে। অনুমতি মেলে  “ম্যায়নে পেয়ার কিয়া” দেখার। সিনেমার সিডি মাঝপথে আটকে গেলে সানি ডায়ালগ বলে বলে  সিনটা দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেয়। আফতাব জড়িয়ে ধরে বলে "তু তো চলতা ফিরতা সিনেমা হ্যায়"। এখান থেকে অন্য একটা  প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজে পাই। যে মানুষটা সিনেমাকে ভালোবাসে তাঁর কাছে সিনেমা সব যে কারনে সেখানে এছবিতে কোথাও প্রেম উঠে আসেনি, কোন প্রেমিকা নেই কিন্তু রোমান্সের অভাব নেই। নারী চরিত্র বিহীন এছবিতে নায়িকার কাজ করে সিনেমা নিয়ে মানুষের ভালোবাসা, সানির ক্যামেরার প্রতি প্রেমিকার মত অন্ধ আকর্ষণ। একটা দৃশ্যে উগ্রপন্থীরা  সানির ক্যামেরা ধরে আছাড় মেরে ভাঙতে গেলে সানি ক্যামেরাটাকে দৃঢ় ভাবে আটকে ধরে রাখে তাঁর শরীরে অবিরাম চড় থাবা পড়তে থাকে। সানি ক্যামেরা ছাড়ে না কিছুতেই। কোন আদেশ বা উপদেশ সে মেনে নেয় না অবশেষে তাঁর এই ভালোবাসার কাছে হার মানতে হয় উগ্রপন্থাকে। মানুষের নেশার কাছে, ভালোবাসার কাছে হার মানতে হয় পেশী শক্তিকে।




এই সানি  ধীরে ধীরে গ্রামের মানুষের কাছে খুব কাছের মানুষ হয়ে ওঠে। সকাল হলে বাচ্চারা তাঁর বন্দিথাকা ঘরের জানালার পাশে এসে ভিড় করে বিভিন্ন সিনেমার ডায়ালগ শোনার জন্য। এখানেও ধর্মীও গোঁড়ামি যা বদলে গিয়ে একুশ শতকের রাজনৈতিক অস্ত্র হয়েছে সেই চোখ রাঙ্গানি সহ্য করতে হয় সানিকে কিন্তু এই শিশুরা তো এত কিছু বোঝেনা।  যে কারনে এই হাসি মজার দৃশ্য থেকে তীব্র শ্লেষ বেরিয়ে আসে। কেমন দেশ ভাগ যা বাচ্চাদের সাথে মিশতে দেয় না। হাসি মজারও বিষয় স্থির করে দেবে শক্তি? যে কারনে একদিন সানিকে গুলি করা হয়। গুলি গিয়ে লাগে তাঁর ডান হাতে। বৃদ্ধ হাকিম সাহেব আসেন সানির চিকিৎসা করতে। তিনি জানতে পারেন সানি ভারতের পাঞ্জাবের বাসিন্দা।  বৃদ্ধ হাকিমের চোখ ধূসর হয়ে আসে। তিনি অনর্গল জানতে চান তাঁর জন্ম ভিটের কথা। কেমন আছে তাঁর ছোটবেলার মহল্লা। সানি বলতে থাকে তাঁর ঠাকুরদার কথা যিনি মৃত্যু মুহূর্ত পর্যন্ত লাহোরের কথা বলে গেছেন, যিনি শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত বিশ্বাস করে গেছেন একদিন তাঁর কাঁটা উঠে যাবে। খাকি পোশাকের মানুষেরা ঘরে ফিরে যাবে। তিনিও ফিরবেন তাঁর জন্মভুমিতে। মজার সিনেমার সব থেকে বড় প্রশ্ন দেশ ভাগ? বৃদ্ধ হাকিম সানিকে ব্যাথা কমার ওষুধ দিয়ে মাথাতে হাত বুলিয়ে ফিরে যান। তখন মরুভুমিতে বিকেল নেমেছে সোনালি আলোতে স্নান করছে প্রকৃতি। এই ফ্রেমের ডেপ্ট ওফ ফিল্ড বরাবর মানুষটার বিদায়ী মুহূর্ত ভীষণ বিষণ্ণতা সৃষ্টি করে। বার বার মনে হয় সোনালি আলোতে স্নান করা পৃথিবীতে এত হানাহানি কেন? কেন এত তারকাটা? কেন ঈদের দিন নতুন কামিজ চেয়ে না পাওয়া মুসলিম বাচ্চা বাড়ি পালিয়ে আজ দুটো রুটির জন্য উগ্রপন্থী, কেন এতো হিংস্র দলাদলি? যে ধর্ম মানুষকে নম্র হতে শেখানো ভুলে গিয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে মন্দির ভেঙ্গে মসজিদ গড়ে আবার দিন বদলে গেলে মসজিদ ভেঙে মন্দির গড়ে। সে ধর্ম মানবতার ধর্ম হতে পারে না কখনও। 

এমন অনেক প্রশ্নের মধ্যে ভারতীয় সানির মুক্তির জন্য  গ্রামবাসীরা আর্জি জানায় উগ্রপন্থী সর্দার কাছে।সানির মুক্তি মঞ্জুর হয়। সানিকে মুক্তি দিতে সীমান্তের কাছে পৌছতে আসল সিদ্ধান্ত সামনে আসে। সানি এবং তাঁর পাকিস্তানি বন্ধু আফতাবকে হত্যা করবার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তারকাটা দিয়ে পেশিশক্তি শক্তি দেখিয়ে  ভাগ করা দেশের একটা মানুষ আর একটা মানুষকে সাহায্য করতে থাকে। পেছন থেকে বৃষ্টির মত অঝোরে গুলি চলতে থাকে,  মরুভুমির বুক চিরে দৌড়তে থাকে সানি আর আফতাব সামনেই ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত। ব্যাকরাউন্ড জুড়ে প্রচারিত হতে থাকে ১৫ এবং ১৬ অগাস্ট স্বাধীন হওয়া দুই দেশের রাষ্ট্র নায়কের বিখ্যাত ভাষণ। সগর্বে ঘোষণা করছেন  তাদের গণতান্ত্রিক দেশ এবং ইসালামী রাষ্ট্র হয়ে ওঠার কথা। ঠিক এই পরিস্থিতে ইংরেজ চলে যাবার এতো বছর পরও দেশ ভাগ দগদগে ক্ষত হয়ে রয়ে যায় অগুনতি হাকিম সাহেবের কাছে। আজও অগুনতি সানি আর আফতাবের বন্ধুত্ব মৃত্যুবরন করে গুলিতে, রাজনীতিতে, উগ্রধর্মীয় আবেগে। বছরের পর বছর ধরে এই বিরাট ক্ষত বিরাট অভিশাপ বুকে নিয়ে দিন গোনে সীমান্তের কাঁটাতার, সীমান্ত নির্দেশক ফলক।

সোমবার, ২ জুন, ২০১৪

  গুড রোড (The Good Road): ভাল রাস্তা নাকি মার্গ অথবা একটা জার্নি


থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে/ দেখব এবার জগতটাকে- কার লেখা বলো ত? কার? কার? ধুর এ কবিতা সিলেবাসে নেই; অনেক আগে থাকত। আর তা ছাড়া জগত ত এখন ঘরেই, পারসোনাল কম্পিউটারের ভিতর সারা জগতকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে; যখন ইচ্ছে তাকে জাগিয়ে তোলো। তবু বাসে ট্রেনে উঠে জানালার ধারে সিটটা পেলে একটা অদৃশ্য হাসি তোমার মুখে ঝিলিক দেয় কেন? কেন না আমরা সবাই দৃশ্য ভালবাসি, চলমান রাস্তার দৃশ্য,জীবনের দৃশ্য। রাস্তার দৃশ্য নিয়ে কম ছবি হয়নি। তবু আবার ও একটা ছবি, রাস্তার ছবি


দূর, দূরের রাস্তা বললেই একটা ট্রাকের চিত্র অনায়াসে মনে ভাসে। ট্রাক ডাইভার পাপ্পু তার সঙ্গী সওকতের চোখে মুখে, শরীরের গড়নে দূর যাত্রার স্থায়ী ছাপ মিতভাষী, জগত সম্বন্ধে নিরুদ্বেগ তাদের যাপন। যাত্রার শুরুতেই দেখছি সওকত জ্বালিয়ে নিল ধূপ অন্যদিকে ড্রাইভার পাপ্পু জ্বালাল বিড়ি। কঠিন মাটির দেশ, গাছপালা হীন রুক্ষ ভূমি, গুজরাতের মানুষগুলোকেও তেমন রেখেছে। বৃত্তের কেন্দ্রের কাছাকাছি থাকা মানুষগুলি কিন্তু এই রুক্ষতার হল্কা বাতাস থেকে বেশ তফাতে। ছুটি কাটাতে আঠাঙ্গাসার পথে চলেছে ডেভিড, সঙ্গে বউ আর ছেলে। নাগরিকতার সমস্ত উপাদানই ঠরে পড়ছে তাদের শরীরীভাষায়। রাস্তায় এই বিচিত্রতা বিভিন্নতা থাকবেই কারন রাস্তা কারো একার নয়। হ্যাঁ এই রাস্তা কিন্তু নয়নাভিরাম নয় বরং অনেক বেশি শুখা অনেক বেশি একঘেয়ে, লম্বা। 


শিশুটি বাবা মার খুচরো ঝগড়ায় নিজেকে সামিল করতে অরাজী, চাদর ঢেকে নেয় নিজেকে বড় রাস্তায় ড্রাইভক্লান্ত ডেভিড একটু ব্রেক নিয়ে নিজেকে তাজা করার জন্যে পথের ধারে গুমটির সামনে গাড়ি থামায়। ধূমপানের ইচ্ছেটা ব্যক্তিগত রাখতে নাকি অন্য কারনে সে চুপিচুপি নেমে যায়। এদিকে আদিত্য, শিশুটির ঘুম ভেঙে গ্যাছে, সে মা কে জল চায়। ঘুমন্ত কিরন গুরুত্ব দিল না, বাইরে তখন সে বাবা কে দেখে চুপি চুপি নেমেও গেল গাড়ি থেকে।  বাইরে এসেই রাস্তা  তাকে পেয়ে বসল, পেয়ে বসল একটা কুকুরছানা। ওদিকে কেয়ারলেস ডেভিড নিশ্চিন্তে দেশীয় সিগারেট নিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে দিয়েছে। এখানেই শুরু হচ্ছে রাস্তার গল্প। গাড়ি স্টার্টের শব্দে আদি  সম্বিত ফিরে পায়, তখন তার চোখের সামনে বেরিয়ে যাচ্ছে বাবা মা,তাদের লাল গাড়িআসলেই সে সাত বছরের একটা স্মার্ট শহুরে ছেলে, সে আমাদের রাহুল নাকি যে ম্যা বলে কান্না জুড়বে! সে দৌড় লাগাল যথাসম্ভব। কিন্তু রাস্তার গতি কে সে ধরবে কীভাবে! অন্যদিকে সমান্তরাল একটি রাস্তার গল্প ছোট্টো পুনমের, সে মুম্বাই ফেরত, চলেছে আঠাঙ্গার পথে তার ঠাম্মার কাছে। পথই তাকে নিয়ে আসে রংমহলায়, এক অন্য দুনিয়ায়, যেখানে সে অনেকটাই অনভিজ্ঞ। দূরের রাস্তায় ভেসে যায় শুখা সুর।  


দৃশ্যে ফিরে আসে রাস্তার ট্রাক ট্রাকের গন্তব্য স্থির হয়, রাস্তার নিয়ম, নিয়মের অনিয়ম,তার সরষে ও সরষের ভূত সবাই আছে রাস্তায় ক্রিমিনাল মালিকের জন্য স্মাগলিংয়ের কাজ নিতে হয় যার জন্য নগদ অর্থ হাতে পায় পাপ্পু। বাইরে উঠোনে বসে থাকা আদি বাব মায়ের ফিরে আসার অপেক্ষা করছে। গুমিটির মালিক এই অযথা ঝামেলা চান না। আঠাঙ্গার পথে ছেলে টিকে তার বাবা মায়ের কাছে পৌঁছে দেয়ার ভার দেয় ড্রাইভার পাপ্পুকে। শিশু আদিত্য উঠে পড়ে ট্রাকে, সঙ্গে মনোহরন কুকুর ছানা। এক রাস্তার গল্পে মিশে গেল অন্য রাস্তা অন্য গল্প। কেন্দ্র এসে দাঁড়াল প্রান্তে। অন্যদিকে ডেভিড ও কিরন আবিস্কার করে, তাদের ছেলে উধাও। ক্যাজুয়াল নগর সিরিয়াসলি তাদের ছেলেকে খুঁজে বেড়ায় তন্ন তন্ন করে। এখানেই দেখা মেলে পুলিশের সহযোগ, বাস্তব টুকরো চিত্র

  
প্রান্তিক হাওয়া বাতাস লাগছে নগরের গায়। ঘটি তুলে জল খেয়ে, ট্রাকবাসীর ঢিলে জামা পরে, ঝাল খাবার খেয়ে আদি পাপ্পুদের কাছের মানুষ হয়ে যায়, স্নেহ জন্মায়, নিজের ভাইঝির কথা মনে পড়ে পাপ্পুর, রুক্ষ মুখে হাসি ঝিলিক দেয়। একসাথে তারা গান হায় হাম হ্যা হিন্দুস্থানী। হ্যাঁ হিন্দুস্থানই বটে, পরিচালক এক আসনে বসালেন হিন্দুস্থানকে।  


পরের গল্প রাস্তার মোড় বদলের। আদি কে খুঁজে পাওয়ার গল্প। সমান্তরাল গল্প এখানে এসে টুকুস করে ছুঁয়ে দেয় মূল গল্প কে।ছোট্টো পুনম বারাঙ্গনা সভা থেকে মুক্তি পায়,তাকে একটি ট্রাকে তুলে দেয়া হয় তার গন্তব্যের পথে। পাপ্পুর ট্রাক ওই ট্রাকের গতির কারনেই দিশা হারিয়ে খাদে পড়ে যেতে থাকে। পুনমকেও জেনে যেতে হয়,এই সব বড় রাস্তায় থামা মানেই কিন্তু সমস্যা। তাদের ট্রাক অন্য ট্রাকের নিচে গড়িয়ে পড়াকে ভ্রুক্ষেপ না করেই চলে যায়, রাস্তার এই ত নিয়ম। ছবির স্বার্থে পাপ্পুদের বড় আঘাত লাগেনি নাকি এমনও হয়!  


আদিত্য কে খুঁজে পেয়ে প্রাণ পেল ডেভিড ,কিরন। উলটে থাকা ট্রাকের অদূরে বসে পাপ্পু বিড়ি ধরায়,তার মুখে সেই চেনা নিস্পৃহ ভাব। বয়সে যুবক সওকত কিছুবা আবেগ তাড়িত হয় আদির জন্য। পাপ্পু অভিজ্ঞ,তার কপালের বলি রেখার মতন কন্ঠ ও স্থির। উঠে চলতে শুরু করেছে সে তখন, রাস্তার পথে।

 

ছবিঃ দি গুড রোড(The Good Road)  / ডি ও পিঃ অমিতাভ সিংহ
লেখা ও পরিচালনাঃ জ্ঞান কোরেয়া  
কাস্টঃ
ডেভিডঃ অজয় গেহি
কিরনঃ সোনালি কুলকারনি
পাপ্পুঃ শামজি ডি. কারাসিয়া
সওকতঃ প্রিয়ঙ্ক উপাধ্যায়
আদিত্যঃ কেবল কাটরোডিয়া
পুনমঃ মিস পুনম রাজপুত
রিঙ্কেলঃ রিঙ্কেল কারেলিয়া  



লেখা: ঊষশী কাজলী।  

রবিবার, ৪ মে, ২০১৪

মিল ও অমিলের মাঝে হারিয়ে যাওয়া অপুর কাহিনী




১৯৫৫ সালে নির্মিত একটি ছবি। একটি পরিবারের কাহিনী। সারাবিশ্বে বাংলা তথা ভারতীয় ছবির সংজ্ঞা বদলে দেওয়া সেই ছবিটি ‘পথের পাঁচালি’। এই ছবিরই পরের দুটো অংশে ছবির পরবর্তী কাহিনীই বহমান। প্রথম অংশে বালক অপু থেকে দ্বিতীয় অংশে যুবক অপূর্ব হয়ে ট্রিলজির শেষ অংশে মধ্যবয়স্ক অপূর্বর অন্তহীন যাত্রার মাধ্যমে ছবির সমাপ্তি। এই ছিল অপুর কাহিনী। বিভূতিভূষণের অপূর্ব এই ভাবেই সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে স্থান পেয়েছিল। আমরা সকলে এক জীবনযাত্রার সাক্ষী হয়েছিলাম। আমরা অপূর্বর সেই মেঠো পথে এগিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে ফেলে রেখে এসেছিলাম তার বাকি জীবন কাহিনীকে। প্রয়োজন হয়নি কখনও পরের কাহিনী ফিরে দেখার। আমরা মেনে নিয়েছিলাম বলা বাহুল্য ভেবে নিয়েছিলাম অপুর জীবনের শান্তিময় পরিসমাপ্তি। কিন্তু সুবীর ব্যানার্জি কে কি আমাদের মনে আছে? নাহ আমার তো ছিল না।

‘পথের পাচালি’তে অপুর চরিত্রে অভিনয় করা শিশু চরিত্রের সামাজিক নাম সুবীর ব্যানার্জি। এরপর আর আমরা তাকে দেখিনা। ভিড়ের মাঝে মিলিয়ে যান তিনি। সেই ভিড়ে কখনও প্রয়োজন হয়নি তাঁকে খুঁজে বের করবার। ২০১৪ তে এসে হঠাৎ তাঁকে খুঁজে পাওয়া গেল ‘অপুর পাঁচালি’তে। ছবির জগতে বিশ্ববন্দিত শিশু চরিত্রগুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান চরিত্র হল অপু। হ্যাঁ ‘পথের পাচালি’র অপু। কিন্তু সুবীর ব্যানার্জির সাথে অপুর সম্পর্ক কোথায়? তিনি কি শুধুই অপুর চরিত্রে অভিনয় করা অভিনেতা নাকি অপুর চরিত্রে অভিনয় করে সাফল্য লাভের পরবর্তী সময়ে হারিয়ে যাওয়ার মধ্যেই আছে তার সাথে অপুর সম্পর্কের কোন অন্তর্ধান রহস্য।

ছবি নিয়ে পড়াশুনা চলাকালিন অপুর সাথে বেশ কিছু সময় কেটেছে। তাঁকে খুব গভীর ভাবে চেনা গেছে। কিন্তু সুবীর বাবুর কথা কোথাও আসেনি। আর এলেও সেটা খুব কম। হয়ত আমিই তাঁকে অগ্রাহ্য করে গেছি। কারন আমার তো অপুকে জানার প্রয়োজন সুবীর বাবুকে তো নয়। কিন্তু এতদসত্তেও কিছু কিছু বইয়ের পাতায় সুবীর বাবুর কথা উঠে এসেছে। অপুর জীবনকাহিনী আর সুবীর বাবুর জীবনকাহিনীর মধ্যে এক আশ্চর্য মিল খুঁজে পাওয়া গেছে। একই সরলরেখায় বহমান দুটি জীবন। একজনের অবস্থান পর্দার ওপারে আর একজনের বাস্তবের মাটিতে।

 

 
২০১৪ তে এসে আপামর বাঙালী জাতি (বিশেষ করে এপার বাংলার) মহোৎসব করতেই পারে কারন প্রায় দীর্ঘ ৬০ বছর বাদে বাস্তবের অপুকে খুঁজে পাওয়া গেছে। চায়ের টেবিলে তর্কের ঝড় তুলতেই পারে যে কতটা মিল আর কতটা অমিল এদের দুজনের মধ্যে। প্রশ্ন উঠতেই পারে ঘোলাটে তামাটে পর্দার অপু অর্থাৎ সুবীর বাবুও কি রূপোলী পর্দার অপুর মত কালপুরুষ দেখেছিল? এরকম কয়েক হাজার প্রশ্ন উঠতেই পারে। আর এর সমস্ত কৃতিত্ব যাবে ‘অপুর পাচালি’র পরিচালকের অপর। শেষমেশ তিনি তো পেরেছেন এই কাজ সম্পন্ন করতে। হাজির তো করতে পেরেছেন অপুকে এত দীর্ঘ অবসানের পর।

জীবনকাহিনী নিয়ে ছবি অনেক হয়েছে। অধুনা ‘ভাগ মিলখা ভাগ’ বা ‘পান সিং তোমার’ এর মত ছবি আমরা দেখেছি। যেখানে ব্যাক্তি উল্লেখযোগ্য স্থান পেয়েছে ছবিতে তার জীবনকাহিনীতে ঘটা কোন ঘটনা নয়। চড়াই উৎরাই সকলকেই পেরিয়ে আসতে হয়েছে। কিন্তু শেষে এসে কোন আফসোস ছিলনা  চরিত্রদের। ‘অপুর পাঁচালি’র ব্যর্থতা এখানেই। বারবার অপু তথা সুবীর ব্যানার্জি আফসোস করতে থাকে তার হারিয়ে যাওয়া নিয়ে। ভুলে যাওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা এটা তিনি মেনে নিতে পারেনা। তাই ছবির শুরু থেকে শেষ অবধি যতবার তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয় তিনিই অপু কিনা ততবার তিনি আকস্মিক ক্রোধে আক্রান্ত হয়ে ওঠেন। ভুলে যাওয়ার পিছনের ঘটনা ব্রাত্যই থাকে।

দর্শককে বারবার অপুর সাথে সুবীর বাবুর সম্পর্কের যে মিল তা বুঝিয়ে বলার প্রবণতা ছবির শুরু থেকে শেষ অবধি করা হয়েছে তা খুব ক্লিশে বলেই মনে হওয়া স্বাভাবিক। পরিচালক ধরেই নিয়েছেন যে ট্রিলজির সব কটা ছবিই সবার দেখা। কিন্তু প্রেক্ষাগৃহে পাশের সিটে বসা যুবক যুবতীরা যখন অপু, ‘অপরাজিত’র অপূর্ব, ‘অপুর সংসার’এর সৌমিত্র এবং ‘অপুর পাঁচালি’র সুবীর বাবুর চরিত্রে অভিনয় করা পরমব্রত ও অর্ধেন্দু ব্যানার্জির মধ্যে খেই হারিয়ে ফেলে বারবার তালগোল পাকিয়ে একাকার করে ফেলে তখন বোঝা যায় যারা নিজের ভোটদান কেন্দ্রের সকল প্রার্থী সম্পর্কেই ওয়াকিবহাল নয় তাদের কাছ থেকে কিভাবে পরিচালক এটা আশা করেন যে তারা এই সকল চরিত্রকে চিনে নিতে পারবেন।

তাই বোঝা দায় হয়ে যায় আসলে পরিচালক ঠিক কি বলতে বসেছেন অপুর সাথে সুবীর বাবুর জীবনযাত্রার মিল নাকি একটি হারিয়ে যাওয়া চরিত্রের গল্প। এত বারবার করে অপু আর সুবীর বাবুকে এক অপরের পরিপূরক হিসেবে দেখানোর কি প্রয়োজন ছিল। অপুর সাথে সুবীর বাবুর পরিচয় করিয়ে দিয়ে তারপর কি তার গল্প বলা যেত না? নাকি ছবির মুল ইউএসপিই এটা ছিল যে কতটা মিল খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। বারবার জোর করে একটা মিল বের করবার প্রবণতা লক্ষ্যনিয়। সেখানে কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়েছে তা বেশ বোঝা যায়। যদি কল্পনার আশ্রয়ই নিতে হয় তাহলে কাল্পনিক আর প্রতীকী চরিত্রের মধ্যে কীভাবে বিভেদ রেখা টানা যায়।

‘পথের পাঁচালি’র সিগনেচার সুর একটা মাইলস্টোন। ট্রিলজির তিনটি ছবিতেই সেই সুর ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজন সাপেক্ষে। দৃশ্যের পরিকাঠামোর ওপর নির্ভর করেছে সুরের ব্যবহার। কিন্তু ‘অপুর পাঁচালি’তে সেই সুর ও শুধুমাত্র এই ছবির জন্য সুরারোপিত সুর প্রায় সর্বক্ষণ দৃশ্যের পশ্চাতে বেজে চলে। যদিও তা অপ্রয়োজনীয় বলেই মনে হওয়া স্বাভাবিক। উল্লেখযোগ্য সুবীর বাবুর বিবাহের দৃশ্য চলাকালীন হঠাৎ করে ক্যামেরার পিছু হঠার সাথে সাথে বাঁশির করুণা মিশ্রিত সুরের ব্যবহারের কি প্রয়োজনিতা তা বিচার সাপেক্ষ। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি সম্পন্ন মস্তিষ্ক এর কারন অনুসন্ধান করতে পারেনা। কারন যদি বিবাহ পরবর্তী জীবনের ভয়ানক পরিস্থিতির কথা ভেবেই এই করুণা মিশ্রিত সুরের ব্যবহার করা হয় তাহলে দর্শকে আগে থেকেই বলে দেওয়ার কোন প্রয়োজন ছিলনা সুবীর বাবু এ সংসারে একা। ছবির শুরু থেকেই ওনাকে একা দেখানো হয়েছে। তাই ধরে নেওয়াই যেতে পারে ওনার একা থাকার পিছনে নিশ্চই কোন কারন আছে অবশ্যই।

অভিনয় নিয়ে আলাদা করে বলার কোন প্রয়োজন নেই। বাংলা ছবির দর্শক বেশ কিছু বছর ধরে বাংলা ছবি দেখে দেখে বুঝে নিতে সক্ষম হয়েছে কোন চরিত্রে কে অভিনয় করতে পারে। দীর্ঘ সময় ধরে এর কোন পরিবর্তন হয়নি আর হবে বলেও কোন আশা করা যায়না। তাই সকলেই যথাযথ অভিনয় করবে বলেই ধরনা কারন চরিত্রেরা সকলেই তাদের পরিমিত গণ্ডির মধ্যেই ঘোরা ফেরা করে।

এসব সত্তেও পরিচালককে বাহবা দিতেই হবে শুধুমাত্র একটি কারনেই যে ক্রমাগত ভুলতে থাকা বাঙালি জাতিকে আরও একবার ফেলে আসা সময়ের চরিত্রদের কথা মনে করিয়ে দেওয়া যারা আমাদেরকে এক এক সময়ে বিশ্বের মানুষের কাছে বাঙালি হিসেবে পরিচয় দিয়ে এসেছে।।

 

ছবিঃ অপুর পাঁচালি

অভিনয়েঃ পরমব্রত, অর্ধেন্দু ব্যানার্জি, পার্নো মিত্র, গৌরব চক্রবর্তী, ঋত্বিক চক্রবর্তী প্রমুখ।

সঙ্গীতঃ ইন্দ্রদীপ দাসগুপ্ত

পরিচালনাঃ কৌশিক গাঙ্গুলি।    

বুধবার, ১২ মার্চ, ২০১৪

হাইওয়ে


 তোমার চারপাশ ঘিরে এত নিয়মের বেড়াজাল এত জৌলুসের দূষণ সেখানে আর সুস্থ সম্পর্কের সবুজ কচি পাতার জন্ম হয় না। অক্সিজেনের বড্ড অভাব । উপহারের বনসাইটাও নিশ্চয় এতদিনে অভিযোজিত হয়ে ফণীমনসা হয়ে গেছে।  এর থেকে ঢের ভাল একটা অপহরন একটা মুক্তি। জীবনের জন্য সিস্টেম থেকে বের হয়ে হাইওয়ে বেয়ে নতুন প্রান খুঁজে নেওয়া।  ভাল আর খারাপের মধ্যের ফারাকটা কি সুধু মাত্র দেখনদারিতে নাকি আরও গভীরে এর শেকড়? অনেক প্রশ্নের একটা উত্তর ইমতিয়াজ আলি’র “হাইওয়ে” ।

 বিয়ের রাতে “ ভীরা” (আলিয়া ভাট) কে একদল ডাকাত অপহরন করে। একটা ট্রাকে পুরো দলটা সারা রাত জুড়ে বিভিন্ন অজানা গন্তব্যে ঘুরতে থাকে । ভীরা মুক্তির জন্য ছটপট করতে থাকে। নৃশংস ভাবে তাকে বেধে রাখা হয়, মুখের মধ্যে গুঁজে দেওয়া হয় কাপড়ের টুকরো যাতে সে চেঁচামেচি না করতে পারে। এরপর এক সময় তার হাতের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়। সে পালিয়ে যেতে চায়, ছুটে যায় ঘন দিকশূন্য অন্ধকারে কিন্তু ঠিক পরমুহুর্তেই সে ফিরে আসে। এখান থেকেই “হায়ওয়ে” রাস্তার ইমেজের সাথে জীবনের পাওয়া না পাওয়ার গল্প বলতে থাকে। দুটো পরস্পর বিরোধী পরিবেশে বেড়ে ওঠা মানুষ । একজন শিল্পপতির মেয়ে আর একজন না খেতে পাওয়া ঘর থেকে উঠে আসা কিডন্যাপার মহাবীর ভাটি ( রনদীপ হুডা) ।

 

 এখানে ছবির সফর চলে সম্বর ,আজমের , বিকানির, ফারিদকোট  এই শহর গুলোর অসাধারণ ল্যান্ডস্কেপে। দুজন অচেনা মানুষের কিছু আত্মকথা আমাদের কে কিছু সত্যের মুখোমুখি দাড় করিয়ে রাখে। ধীরে ধীরে আমরাও কেমন যেন লজ্জিত হয়ে আত্মসমর্পণ করি এই দুটি মানুষের কাছে। বুঝতে পারি কেন এই সুশিক্ষিত মেয়েটি কিছুতেই বাড়ি ফিরতে চায়নাকেন সে তার জৌলুস মোড়া জীবনকে ঘেন্না করে। একে একে সে তথাকথিত বস্তুবাদী অন্তরসারশূন্য অগুনতি পরিবারের মেয়েদের মুখ হয়ে ওঠে । সে এক রাতে প্রকাশ করে ফেলে যে কিভাবে শৈশব থেকে বার বার অভিভাবকের কাছে যৌন নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করতে হয়েছে। কিভাবে রূপকথার আড়ালে চুরি হয়ে গেছে মেয়েবেলা।

 ট্রাক থেমে থাকে না।  ল্যান্ডস্কেপ কাজা, পেহেল্গাও, আরহ ঘুরে সুন্দর থেকে আর সুন্দর হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের অস্বস্তি কমে না , আসলে কমবে বা কিভাবে পর্দা থেকে শ্লেষের থুতু গুলোতে আমাদের সারা শরীরে পড়তে থাকে। যেখানে এক ছেলে যে নিজে কিডন্যাপার কিন্তু সেতো প্রতিমুহুর্তে ফ্ল্যাশব্যাকে দেখতে পায় “মা কে নিয়ে একটা ছোট্ট চাষি ঘর, দু মুঠো খাবার আর মায়ের সম্মান” এতুটুকু তাকে আমাদের এই সিস্টেম দিতে পারেনি। তাহলে পারলোটা কি? সমাজের দুটি প্রান্তসীমা এত নিরাপত্তা হীনতাতে ভুগছে? আলোর রোশনায় ভর্তি ঘরেও একটি কিশোরী দিনের পর দিন অত্যাচারিত , অন্ধকারের নীচে থাকা একটা কিশোর দুমুঠো ভাতের জন্য শৈশব বিসর্জন দিয়ে হাতে তুলে নেয় অস্ত্র। জীবনের “হাইওয়ে” বড্ড কঠিন , বড্ড প্যাঁচালো এখান থেকে মুক্তি পাওয়া অত সহজ নয়।
 আশ্চর্যময়ী বিশ্বাস করো সিনেমা থেকে বেরিয়ে ইমতিয়াজ কখন যেন ছুয়ে যায় তোমাকে। যতবার “ভীরা” গাছকে, পাথরকে, ঝর্ণাকে, আকাশাকে, জড়িয়ে ধরে ততবার তুমি প্রাণ ভরে অক্সিজেন নিতে পার। এই যে একলা থাকা তুমি রাস্তা ঘাটে চলাফেরার সময় তোমার দশদিক থেকে হিংস্র কুকুরের মত দৃষ্টিতে তাকানো মানুষদের থেকে দূরে যেতে চাও তা জানি, কিন্তু যেতে পার কি? সিনেমা হয়ত একারনেই সিনেমা সব না পারাদের পারা নিয়ে কথা বলে।

 হাইওয়ে ছবির এই দুই স্তরের ভাবনার পাশাপাশি এ আর রহমান এক নিশ্চিন্ত যাপনে চলাফেরা করিয়েছেন আমাদের মননকে , কখন ঘুম পাড়ানি লোকগান বা শুধুমাত্র সবুজ পাহাড়ি উপত্যকা জুড়ে পশুপালকদের মুখে ঘোড়া শব্দ জুড়ে সুর তৈরি করে। কিন্তু সব সফর শেষেও তথাকথিত প্রেম বলতে যেটা আমরা বুঝি সেটা বাদেও কিছু একটা তৈরি হয় ছবির  দুই প্রটাগনিস্টের মধ্যে , যে সম্পর্ক বোঝার চেষ্টা সভ্য সমাজ করে না । বরং রাষ্ট্র বন্দুক হাতে নেমে পড়ে তার দেশের একজন বেয়াড়া নাগরিককে শিক্ষা দিতে। গুলিতে ঝাঁজরা হয় স্বীকৃতিহীন আস্থা, এতদিনের ভরসার খোঁজ নিতে গেলে ঘুমপাড়ানি ইনেজক্সন জোটে । এভাবেই ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ে একটা সমাজ। সব কিছু পেরিয়ে দু একটা ভীরা অস্ফুটে বলে ওঠে “ আমার সমুদ্র দেখার খুব ইচ্ছে, জানিনা পূরণ হবে কিনা, ছেলে হলে ভাল হত অন্তত ঘরের বাইরেটা দেখতে পারতাম, জানতে পারতাম সিস্টেমের বাইরে মানুষ কিভাবে বাঁচে?” কিন্তু এদের জন্য একটাও হায়ওয়ে  নেই, একটাও কিডন্যাপার নেই, শুধুমাত্র একটা দমকা বাতাস বার্তা বয়ে আনে “ এই নাও মুঠো ভরে অক্সিজেন ছড়িয়ে দিলাম, দম দেওয়া পুতুল এবারতো শ্বাস নাও” ।  
আর যে দু একজন জেদি মানুষ ঘুমোয় না তারা প্রশ্ন করে, উত্তর না পেয়ে একা একা বাঁচতে শুরু করে সব সামাজিক ভাল মন্দের বাইরে গিয়ে।

ছবি- হাইওয়ে

অভিনয়ে- রনদীপ হুডা, আলিয়া ভাট প্রমুখ।

সঙ্গীত- এ.আর. রহমান

পরিচালনায়- ইমতিয়াজ আলি।                       

রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৩

চাঁদের পাহাড়





উঁচু পাহাড়ের গা ঘেঁষে হেলিকপ্টারে ক্যামেরা নামে আফ্রিকাতে জঙ্গল পাহাড় নদী পেরিয়ে আরও গভীরে ক্যামেরা খুজে পায় শঙ্করের প্ল্যাটফর্ম , জনমানব শূন্য এলাকা চারিদিকে শুকনো ঘাস। এই তো সেই উঁচু শুকনো ঘাসের আফ্রিকা তার মাঝে আমাদের বাংলার ছেলে শঙ্কর পেছনে মানুষ খেকো সিংহ। শঙ্কর কি করবে? হত্যা করবে? পালিয়ে আসবে? না না সিনেমার শঙ্কর এত কিছু ভাবে না । তাঁকে বুনো হাতির আগে দৌড়তে হয় , একটা লাফ দিয়ে ইউটার্ন নিয়ে গুলি করতে হয় না হলে যে ১৫ কোটির চাঁদের পাহাড়ের “হিরো শঙ্করের” চরিত্রের গঠন সম্পূর্ণ হয় না।

উপন্যাস থেকে ছবি করার ক্ষেত্রে এই গল্পবলার পদ্ধুতিগত দ্বন্দ্ব চিরকালীন । কিন্তু সিনেমার শঙ্করের ক্ষেত্রে একটু বেশী অগোছালো। সারা চাঁদের পাহাড়  ছবি জুড়ে এই লড়াই চলে। কিছুটা সময় শঙ্কর নিজে গল্পটা বলে কিছুটা সময় তৃতীয় গল্পকার, সেখানেই মূল দ্বন্দ্ব। শঙ্কর প্রথমে হাতির সাথে লড়াই করে , দক্ষিণ ভারতীয় বন্ধু তিরুমলকে মেরে ফেলা মানুষ খেকো সিংহকে হত্যা করতে আফ্রিকান মাসাইদের মত নিজের সারা শরীরে রক্ত ঢেলে মাংস ছড়িয়ে যে পরিবেশ ছবিতে সংগঠিত হয় সেটা তো শঙ্কর নয় সেটা ভারতীয় বানিজ্যিক ছবির হিরো। এটা তো বহুদিনের ছক সেই শোলে থেকে দেবের রংবাজ পর্যন্ত এই সফর জুড়ে এই হিরোর দাপাদাপি ।



কিন্তু চাঁদের পাহাড়ে শঙ্করের চরিত্র ধীরে ধীরে দৃঢ় হয়, সুরুতে সে একজন পরিব্রাজক তার পর অ্যাল্ভারেজের সঙ্গী শঙ্করকে আফ্রিকার জঙ্গলের জীবন একজন দৃঢ় যোদ্ধাতে পরিণত করে । জীবন তাঁকে শেখায় একটা সময় যে শঙ্করের পেছন পেছন সিংহ তার ষ্টেশনের ঘর পর্যন্ত চলে আসে , যে শঙ্কর প্রায় সারারাত সিংহের সাথে লুকোচুরি খেলে বেঁচে থাকে সেই শঙ্কর তো আবার বুনিপ নামক একটা বিরাট জন্তুকে হত্যা করে। কাজেই ছবিটা প্রচণ্ড খারাপ এটা ঠিক নয় অসুবিধাটা আসলে সম্পাদনার ক্ষেত্রে বড্ড ব্যস্ততা ছবিটাকে ঘেঁটে দিয়েছে, যে কারনে ছবি দেখতে বসলে বার বার জার্ক লাগে। দেব ছবিটা জুড়ে ভীষণ খারাপ বাংলা বলেন কিন্তু বাংলা ছবিতে ১৫ কোটির লগ্নি যে দেব ছাড়া করা এক কথায় অসম্ভব । যে প্রজন্মটা চাঁদের পাহাড় বই টা পড়েনি তারা তো কিছু একটা আকর্ষণে ছবিটা দেখতে আসবে?  মুল কথা বানিজ্য । কিন্তু একথাও তো সত্যি হাতে সব উপাদান থাকা সত্তেও শুধু বানিজ্যের দিকে তাকিয়ে একটা ননলাইনার জার্ক ভর্তি ছবি বানাতে হবে?

আমি ব্যাক্তিগত ভাবে এই নীতিতে বিশ্বাস করিনা , যেমন আমার ওই আগ্নেয়গিরির দৃশ্য বা বুনিপের অ্যানিমেশন প্রচণ্ড গোঁজামিল লেগেছে। আবার অ্যাল্ভারেজের সাথে শঙ্করের জার্নির প্রথম অংশ ভালো লেগেছে। তবে একথা ঠিক যদি একজন মাত্র নির্দিষ্ট গল্পকারের জবানিতে ছবিটা বলা হত তাতে দৃশ্যগুলো আরও শক্তিশালী হত। এবং বারে বারে গল্পের ডায়মেনসন বদলাতে গিয়ে ছবির শরীরে অবাঞ্জিত মেদ বাড়তে থাকে । যে কারনে ছবিকে বিরতির পর ভুগতে হয় চমকের অভাবে কিন্তু এখানেই তো চাঁদের পাহাড় ছাপিয়ে যেতে পারত সমকালিন সব ছবিকে। অ্যাল্ভারেজ বার বার পথ হারাচ্ছেন, ডেথ ট্র্যাপে পড়ছেন , আগ্নেয়গিরির সামনে পৌঁছে যাচ্ছেন , খাবার ও জল ফুরিয়ে যাচ্ছে। গুরু মারা গেলেন শিস্য একা হয়ে গেল এই জঙ্গলে।  যে নিজে    সেক্সট্যান্ট যন্ত্রের ব্যবহার জানে না , সে তারা দেখে দিক নির্ণয় করতে পারে না। যে হীরের খোঁজে জীবন বাজি রেখে এতটা পথ সে পেরিয়ে এসেছে সেই হীরের খনিতে শঙ্কর । এটা হতে পারত ছবির সব থেকে প্রভাবশালী দৃশ্য যে জীবন কত কঠিন, আজ শঙ্করের চারিদিকে হীরে আর হীরে সে হীরে চিনতে পারে না শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে। ডেথ ট্র্যাপ ভেঙে বেরোনোর জন্য সে হীরে দিয়ে দিক চিহ্ন তৈরি করে। এখানে তো স্পেস ডিভিশন হতে পারত যেমন “মিরর”  ছবিতে হয়েছিলো। নিশ্চিন্তে পরিচালক কমলেশ্বরবাবু জীবনের সবথেকে বড় সত্য কে ধরতে পারতেন “যে হীরের জন্য জীবন বাজি রেখে এতটা পথ চলা , বেঁচে থাকার তাগিদে সেই হীরে বিসর্জন দিয়ে জীবনকে খোঁজা একটু জল আর একটু খাবার তাগিদে”।  এই অংশটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভাবে ধরা যেত পর্দাতে। শঙ্করের চরিত্রের গঠন সম্পূর্ণ হতে পারত এই  ক্রাইসিসে । চাঁদের  পাহাড়ের আসল সত্য সফর , এবং অবস্থার সাথে সাথে শঙ্করের চরিত্রের পরিবর্তন এটুকু বাদে আর সব আছে কমলেশ্বর বাবুর এই ছবিতে । শৌমীক হালদারের অতন্ত শক্তিশালী ক্যামেরা আফ্রিকাকে ধরে, জুলু নাচ কে ধরে, বাঘ,  সিংহ , ব্লাক মাম্বা সহ একটা গোটা জীবন্ত সফরকে ধরেন শুধু বিভূতিভূষণের ভয়ঙ্কর অথচ সুন্দর , শান্তির অথচ হিংস্রতার নিঃশ্বাস কে ধরতে পারেন না চিত্রনাট্যের দুর্বলতার জন্য।    



কিন্তু এত কিছুর পর ও তো ছবিটা চলে, নতুন প্রজন্ম ভিড় করে । তারা জানতে পারে শঙ্কর নামক এক সাহসী বাঙালি যুবকের কথা। বাংলা পাঠ্য বই থেকে শঙ্কর বিদায় নিয়েছে অনেকদিন।  এখন সুধু আগ্নেয়গিরির অংশটা কিছু ছেলে মেয়ে পরীক্ষার জন্য পড়ে “সূর্যের নাভির মত” শিরোনামে। এরাও একদিন জানবে সেই ধুতি পাঞ্জাবি পরা মানুষটির কথা। যার উপন্যাসের ভিত্তিতে বিলেত ফেরত এক যুবক অনেক অর্থকষ্ট পেরিয়ে সরকারি অনুদান নিয়ে প্রায় চার বছর ধরে ধুকে ধুকে “পথের পাঁচালী” বানিয়েছিলেন। না সেখানে রিলিজ ডেটের তাড়া ছিল না। পাবলিসিটির প্রচণ্ড ধান্দা ছিল না।  তবে নায়ক নায়িকা বর্জিত  ছবিতে আশঙ্কা ছিল “চার বছরে অপুর ( অভিনেতা সুবীর ব্যানার্জী) বিরাট কোনও শারীরিক পরিবর্তন হয় কিনা, কিন্তু তা হয়নি, হলে হয়ত আর ছবিটা করা হতনা” । এখানেই সময় কথা বলে দামি বাজেটের মার্কেট না চিরকালীন পারফেকশন ?  এসব কোনও কিছুই যদিও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কে কোনোদিন ছুঁতে পারেনি। ছোঁবেও বা কি ভাবে? তার সময়ের বাজার তার মুল্য হয়ত বোঝেনি তাই অবহেলা জুটেছে। এদিকে আজ এত বছর পর শ্বাসকষ্টে ধুঁকতে থাকা বাংলা বইশিল্প , যেখানে বড় পাবলিকেশন হাউস বইবাজার বিশ্লেষণ করে “খাচ্ছে” বলে একের পর এক রাবিশ পাঠের অযোগ্য বই প্রকাশ করে যাচ্ছে। একটার বদলে সমগ্র প্রকাশে আগ্রহী হচ্ছেন সেখানে এখনো একা একা পাল্লা দিয়ে বিকচ্ছে “চাঁদের পাহাড়”,“আরণ্যক” ।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর চাঁদের পাহাড়ের সেই হীরক খনি যেখানে গড়া গড়ি যায় অসংখ্য হীরের টুকরো সেখান থেকে দু একটা হিরে অপচয় হয় ছবি করতে গিয়ে, পড়ে থাকে আরও অনেক।  আজ বাংলা ছবির সুখের দিন কিন্তু কঠিন সময়ে হয়ত আবার এই খনি থেকে অন্য একটা হীরে নিয়ে ছবি হবে , যেখানে বাজেটের চাপ থাকবে না, মার্কেটের লাল চোখ থাকবে না।  বরং এক মুঠো অক্সিজেন থাকবে , যে অক্সিজেন প্রতিরাতে  ফিল্মস্টাডিজের এক নাম না জানা ছাত্রের বালিশের পাশে রাখা আপনার অ্যাল্ভারেজ, দব্রুপান্না , অপু , দুর্গার থেকে বাহিত হবে স্বপ্ন থেকে স্বপ্নে । আপসহীন ছবি  করার স্বপ্নে। 


ছবিঃ চাঁদের পাহাড়
মূলকাহিনীঃ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
পরিচালনাঃ কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় 


                                                            কৃতজ্ঞতা ঃ আদিত্য। 

বুধবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৩

একটা কুড়িয়ে পাওয়া চিরকূট


একটা কুড়িয়ে পাওয়া চিরকূট...
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। দরজায় কে যেন এসে কড়া নাড়লো। একবার...দুবার...তিনবার। ঘুম চোখে উঠে দরজা খুলে দেখি হলুদ পাঞ্জাবি পরা এক ভদ্রলোক। আমার দিকে তাকিয়ে। আমি কিছু বলার আগেই নমস্কার করে বললো “ আমাকে আপনি চিনবেন না। খুব দুঃখিত এতো রাতে বিরক্ত করার জন্য। আমার নাম হিমু। একটু ঘুরে আসবেন নাকি শাহবাগ থেকে? হাঁটতে কোনো অসুবিধে হবে না তো?” কিছু বলার সুযোগ দিল না লোকটা। আমার দিকে একটা চাদর এগিয়ে দিয়ে বললো “পরে নিন। ঠান্ডা তেমন নেই...তবে।” রাস্তায় নেমে হাঁটতে শুরু করলাম। মোড়ে মোড়ে পুলিশ। মোড়ে মোড়ে থমথমে বিষণ্ণতা।
আপনাকে খুব চেনা লাগে। আপনাকে কোথায়...?
“দেখেননি...। কী করে দেখবেন? হিমালয়কে সচারচর দেখা যায় নাকি?”
শাহবাগের মোড়ে আলোর রোশনাই। শাহবাগের মোড়ে চিৎকার। “রাজাকারের ফাঁসি চাই।”
একটু এগিয়ে গিয়ে হিমু দাঁড়িয়ে পড়ে। রাস্তার মাঝে সাদা পর্দা টাঙিয়ে একটা ছবি দেখানো হচ্ছে। সামনে বসে আছে কিছু মানুষ। স্লোগান...
জানেন...এই ছবিটা আমার চেনা।




ভদ্রলোক হাসে। শীতের হাওয়ায় চাদর উড়ছে। “মুক্তির গান। আপনারা ক্লাসে দেখতেন। একটা লেখা লিখেছিলেন...। মনে আছে?”
আপনাকে আমি কোথায় যেন একটা...
“দেখেননি...কী করে দেখবেন? আমি ওই ভিড়টায় মিশে থাকি।”
রাস্তার পাশে তরুণদের মিছিল। রাস্তার পাশে বড় ফেস্টুনে লেখা এগিয়ে আসছে ‘বিজয় উৎসব...।’
কিন্তু আমি আপনাকে...
লোকটা ঘুরে তাকায় আমার দিকে।
“কেমন একটা হাস্যকর পরিস্থিতি না ভাই? আমাদের দুই দেশের? আপনাদের মহান আইন ভালবাসাকে ক্রাইম বলে। আর আমাদের দেশ...। না থাক...আপনার এ্যারেস্ট হবার ভয় আছে।”
আমি থমকে দাঁড়াই।
“বাড়ির সামনেটা পৌঁছে গেলে আমাকে একটা মিসড কল দেবেন। আমি বেকার কিনা। মোবাইলে টাকা ভরার টাকা নাই...। ও ভালো কথা...আমার নাম আসলে হিমু নয়...আমি আসলে ছিদাম...আবার ঠিক ছিদামও নয়...আমি আসলে মানুষ...। যে মানুষের মৃত্যু মিছিল আপনি ইতিহাসের বইতে পড়েছেন...। জানি লেটার মার্ক্স ছিল মাধ্যমিকে আপনার।”
**** চিরকূটটা এখানেই শেষ। লেখকের নাম জানি না। ঘটি গরম কেনার সময় হয়তো কেউ ফেলে গেছে নোংরা কাগজ হিসেবে। কিম্বা ফেলেনি...ইচ্ছে করে রেখে গেছে কেউ পড়বে বলে।*****